❤ গল্পঃ ছোট্ট বৌমা ❤
লেখকঃ হাসান মাহমুদ
রাহাত সাহেব ভোরবেলা বাগানে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। প্রভাতে মৃদু বায়ু আর পাখিদের কিচিরমির স্বর তাঁর মনকে সতেজ করে তোলছে। তখন আতিকা বেগম তাঁর স্বামীর জন্য চা নিয়ে এলেন। রাহাত সাহেব পত্রিকা রেখে প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে, তাকে পাশে বসতে বললেন।
আতিকা স্বামীর পাশে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প শুরু করলেন নিজেদের হারিয়ে যাওয়া সুখ-দুঃখে ভরা অতীত নিয়ে। যেগুলো তাঁরা ভাগ করেছেন একসাথে হাসিমুখে। আজ তাঁরা এক সন্তানের বাবা-মা। তাদের সন্তান নিয়ে তাঁরা কত শত স্বপ্ন দেখেছেন। দু'জন মিলে সেই আলোচনা করছিলেন।
হঠাৎ আতিকা বললেনঃ আয়ানের বাবা! আমাদের ছেলেতো এইবার ইন্টার দিয়ে দিয়েছে। তাঁর তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। অথচ এখনো আমরা তাকে টাকা রুজির কোন পথ করে দিচ্ছিনা। পরে তো তাকেও আমাদের মত কষ্ট করতে হবে, বিয়ে করার জন্যে। ছেলের বয়স হয়ে যাবে, বেশি টাকা রুজি না করার বাহানায় মানুষ বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।
রাহাত সাহেব চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে বললেনঃ তুমি ঠিক বলেছো। ওর টাকা আয়ের জন্য কিছু একটা করতে হবে। আর তা করতে তাকে আগ্রহী করার জন্য আমাদের বৌমাও দেখতে হবে।
আতিকা মুচকি হাসি দিয়ে বললেনঃ বৌমা আমার ঠিক করা আছে। রাহাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন কে? আতিকা বললেনঃ আমার বান্ধবীর মেয়ে নাঈমা। রাহাত সাহেব বললেনঃ তোমার পছন্দ আমার মনের মত হয়েছে। আজ তাহলে বৌমাকে দেখতে যাবো। আর আয়ানকে ওয়েভ ডেভলাপিং কোর্সে ভর্তি করে দিবো।
দুপুরের খাবার খাওয়া হয়ে গেলে, রাহাত সাহেব আয়ানকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন কোর্সে। আর বললেন মন দিয়ে কাজ শিখতে। অতঃপর তিনি বাসায় ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে নাঈমাদের বাসায় চলে গেলেন। নাঈমার বাবা নেই। মা ব্যাংকে চাকরী করেন। অনেকদিনপর দু'বান্ধবী একত্রিত হয়ে গল্প শুরু করে দিলেন। গল্পের ফাঁকে আতিকা নাঈমার মাকে নাঈমাকে পুত্রবধু বানানোর প্রস্তাব দিলেন।
নাঈমার মা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তাঁর চুখে আনন্দের অশ্রু এসে গেছে। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তবে তিনি বললেনঃ নাঈমা তো এখনো ইন্টার দেয়নি। আর আয়ানও কোন জব বা ব্যবসা শুরু করেনি।
আতিকা বললেনঃ আমিতো এখনই তাদেরকে বিয়ে দিয়ে সংসার শুরু করার কথা বলছিনা। এখন তাদের আকদ করে রাখবো। পরে আয়ানের জব হয়ে গেলে তাদেরকে একত্রিত করে দিবো। নাঈমার মা রাজি হলেন এই প্রস্তাবে।
অতঃপর আতিকা আর রাহাত সাহেব বাসায় ফিরে ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন। আর বলে দিলেন ভালো একটা চাকরি শুরু না করা পর্যন্ত নাঈমাকে বাসায় আনা হবেনা।
একদিনপর আয়ান-নাঈমার আকদ হয়ে গেলো। আয়ান নাঈমাকে কথা দিলো সে ভালো করে পড়াশুনা করে একটি জব পেয়েই তাকে বাসায় নিয়ে যেতে আসবে। দু'জন চোখের জলে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে গেলো।
আয়ান এখন ওয়েব ডেভলাপিং শিখতে আরো মনোযোগি হয়েছে। ফোনে দু'জন দু'জনের খবর নিচ্ছে। কেউ আর অযথা সময় নষ্ট করছেন। একে অপরের খেয়াল নিচ্ছে। নাঈমাও পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। তাকেও যে ভালো রিজাল্ট করে শশুর-শাশুড়ির সামনে আরো সম্মানিত হতে হবে।
দু'বছরপর আয়ান বাসায় মিষ্টি নিয়ে আসে। তাঁর আনন্দ দেখে বাবা-মা দৌড়ে আসেন। বলেনঃ আয়ান কী হয়েছে? আয়ান বললোঃ আমার আমেরিকার একটি কোম্পানিতে ওয়েভ ডেভলপার হিসেবে চাকরী হয়েছে। রাহাত সাহেব বললেনঃ তাহলে তো আমাদের বৌমাকে নিয়ে আসতে হবে। এদিকে নাঈমার ইন্টার পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে।
পরদিন রাহাত সাহেব প্রতিবেশিদের নিয়ে একটি বিশাল আয়োজন করে নাঈমাকে বৌমা হিসেবে ঘরে নিয়ে আসলেন। শুরু হলো আয়ান-নাঈমার দাম্পত্য জীবন। যে জীবনটি শুরু হয়েছে সঠিক সময়ে। রাহাত সাহেব আর আতিকার মত জ্ঞানী মা-বাবার কল্যানে।
ছোট্ট বৌমা
উৎসাহ
❤ গল্পঃ উৎসাহ ❤
লেখকঃ হাসান মাহমুদ
তখন আবির অনেক ছোট। বয়স সাত কিংবা আট হবে। সে তাঁর বাবার কাজে সহযোগিতা করছে। বাবা আবিরের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ আবির! তুমি কি আজ স্কুলে যাবেনা? স্কুলের সময় তো হয়ে গেছে। আবির বললোঃ বাবা আজ স্কুল বন্ধ। তাই আজ আমি আপনার কাজে হেল্প করবো।
বাবা কিছুক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললেনঃ আবির তুমি কি কবিতা লেখতে পারো? আবির বললোঃ হ্যাঁ! বইয়ের সকল কবিতা আমার মুখস্থ। বাবা বললেনঃ ওইগুলো না। তুমি কি নিজে বানিয়ে লেখতে পারো? আবির তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো " হ্যাঁ বাবা আমি লিখতে পারবো। আবিরের এমন সাহসি জবাব বাবাকে মুগ্ধ করলো। বাবা বললেনঃ তুমি পারবে। তুমি এখন গিয়ে একটা কবিতা লেখে এনে দেখাওতো।
আবির দৌড়ে ঘরে গিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসলো। জানালা দিয়ে দেখতে থাকলো নীল আকাশ আর সবুজ প্রকৃতি। রয়েছে নানা রকম পাখি আর তাদের মন মাতানো সুর। সে লেখতে লাগলো আপন মনে। প্রতিটি লাইনে যেন ছন্দের মুক্তা বয়ে যাচ্ছে। সে তোলে ধরার চেষ্টা করছে আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ মহিমকে। সৃষ্টির সৌন্দর্য তোলে ধরছে নিষ্পাপ মনের মাধুরী মিশিয়ে।
ইতিমধ্যে আট লাইন লেখা হয়ে গেছে। পরীক্ষায় স্বাভাবিকভাবে আট লাইন লিখে দিলেও হয়। তাই সে আট লাইন লিখে খাতা নিয়ে গেল বাবার কাছে। বাবা নিজের কাজ রেখে গাছের ছায়ায় নিয়ে গেলেন আবিরকে। খাতা হাতে নিয়ে পড়তে থাকলেন, আবিরের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে। পড়া শেষ হতেই মা শা আল্লাহ বলে পরম মমতায় আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আর চুমে খেলেন তাঁর কপালে। বললেনঃ বাবা খুব সুন্দর হয়েছে। তোমার লেখা কবিতা পুরো কবিদের মত হয়েছে। তুমি পারবে। তুমি কি এই পুরোপৃষ্টা ভরে কবিতার বাকি অংশ লিখতে পারবে? বাবার উৎসাহ পেয়ে আবির বললোঃ ইন শা আল্লাহ! অবশ্যই আমি বাকিটুকুও পারবো।
আবির ঘরে ফিরে পুনরায় লেখতে বসে। তাঁর এক লাইন শেষ হতেই, অন্য লাইনের ছন্দের মালা ঝরছে। এভাবে এক পৃষ্টা, দু'পৃষ্টা, তিন পৃষ্টা লিখে নেয়। বাবা ঘরে আসলে, আবির তাঁর লেখা কবিতা পড়ে শুনায় সবাইকে। সবাই তাকে উৎসাহ দেয়। সেদিন থেকে আবির পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই কবিতা লেখে বাবাকে উপহার দেয়।
একদা এক গল্পের বই আবির দেখতে পায়। সে তা খুব ভালো করে পড়ে। বইটি পড়া শেষে আরেকটি বই হাতে নেয়। যতই গল্প পড়ে ততই তাঁর মাথায় নতুন কোন গল্পের আইডিয়া আসে। সে বাড়ি ফিরে খাতা কলম হাতে নিয়ে লেখতে বসে। ঘণ্টা খানেকপর দেখে তাঁর এক গল্পের পরিধি পাঁচ পৃষ্টা হয়ে গেছে। সে আনন্দের সাথে বাবা বাবা বলে চিৎকার দিয়ে বাবার কাছে যায়। বাবা তাঁর এমন খুশি দেখে তাঁর খুশিতে তিনিও শরীক হলেন। তিনি তাকে পাশে বসিয়ে পড়তে থাকলেন তাঁর প্রিয় ছেলের লেখা প্রথম গল্প। তিনি গল্প পড়ে আনন্দিত হলেন। বললেনঃ বাবা তুমি আমার গর্ব।
সেদিন থেকে কবিতার পাশাপাশি আবির গল্প লেখতে শুরু করে। কিন্তু সে জানতো না ছোট গল্প আর উপন্যাস কাকে বলে। একদিন দেখে তাঁর এক সহপাঠি খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন এক বই পড়ছে। সে তাকে গিয়ে ডাকলো। কিন্তু সহপাঠিটি যেন কিছুই শুনছেনা। হারিয়ে গেছে অজানা কোন এক জগতে।
ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরার সময় হলো। আবির তাঁর সেই বন্ধুকে বলেঃ তোমার বইটি কি আমাকে দেওয়া যাবে? বন্ধু বললোঃ হ্যাঁ, তুমি নিতে পারবে। আমার পুরো বই পড়া শেষ হয়ে গেছে। আবির কৌতূহল স্বরে বললোঃ পুরো বই! আমাকে তো পড়তেই হবে।
বাড়ি এসে বইটি খোললো। দেখে এটি একটি উপন্যাস। যে উপন্যাস পড়ার জন্য সে উদগ্রীব হয়েছিলো। সে একাধারে বসে বইটি পড়ে নিলো। এবার তাঁর আরেকটি বই লাগবে। লাইব্রেরী থেকে আরেকটি উপন্যাস কিনে আনলো। এভাবে অনেক বই পড়া হয়ে গেলে ভাবলো তাঁর মনেও তো এমন কত শত গল্প উঁকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সে কীভাবে শুরু করবে? উপন্যাস লেখার নিয়ম কী তা জানতে অনলাইনে সার্চ দিলো। সাথে সাথে পেয়ে গেলো তাঁর কাঙ্ক্ষিত উত্তর। সে তা আত্মস্থ করে নিলো। এরপর শুরু করলো তাঁর উপন্যাস লেখার যাত্রা।
যেদিন থেকে সে গল্প,কবিতা, উপন্যাস লেখা পুরোদমে শুরু করলো। সেদিন থেকে সে লক্ষ্য করলো তাঁর পড়ার গতী আরো বেড়ে গেছে। সে এখন বড় কোন প্রশ্ন বা বই দেখলে ভয় পায়না। ভাবে এমন বইতো আমি মাত্র দুই, তিনদিনেই শেষ করতে পারি। কোন জিনিসের সারমর্ম জানলে বাকিগুলো অনায়াসে লেখতে পারি। সে দেখলো তাঁর বানান, শব্দ চয়ন আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছে। কারণ বই পড়ার সময় সে বানান, নতুন নতুন শব্দের অর্থ জানার চেষ্টা করে। যাতে লেখতে সুবিধা হয়। নতুন নতুন শব্দ যোগের ফলে লেখনীর সৌন্দর্য বেড়ে উঠে।
হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা
❤ গল্পঃ হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ❤
লেখকঃ হাসান মাহমুদ
অনেক দিয়ে হয়ে গেছে। আবির বের হয়নি দূর কোথাও ভ্রমণ করতে। সারাদিন অনলাইনে কাজ করতে করতে, মনে হচ্ছে সে কারাবদ্ধ হয়ে আছে। বাহিরের চিরচেনা জগৎ যেন আজ অচেনা মনে হচ্ছে। তাই সে ভাবলো দূর কোথায় বেড়াতে যাবে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিশাল সমুদ্রের কথা। জীবনের চব্বিশ বসন্ত পার হয়ে গেছে। আজও দেখা হয়নি সাগরের বিশালতা। শুনা হয়নি জোয়ারের সাঁ সাঁ ধ্বনি। দেখা হয়নি মুক্ত আকাশে সূর্য উদয় হওয়া।
যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুত অনলাইন থেকে কক্সবাজার যাওয়ার টিকেট কিনে রওয়ানা হয়ে গেলে আপন গন্তব্যে। যেতে যেতে পরদিন দূপুর হয়ে গেলো। সমূদ্রের পাশে এক বিলাশ বহুল হোটেলে রুম ভাড়া করে বিশ্রাম নিলো। ক্লান্ত দেহ বিছানার ছোঁয়া পেতেই চোখ জোড়ে গভীর ঘুম চলে এলো।
বিকেলবেলা ঘুম ভাঙ্গতেই দেখে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বাহিরে বাতাস বয়ে চলছে। যেন এই বাতাস তার সকল ক্লান্তি দূর করে দিতে এসেছে। সে দ্রুত বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আসরের নামাযে চলে গেলো। নামায শেষে চলে গেলো সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। একা একা হাটছে হাটু জলে। সমুদ্রের বিশাল জোয়ার আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তীরে।
এই সেই সমুদ্র যা নিয়ে লেখা হয়েছে কত কবিতা,গল্প। রয়েছে কত ইতিহাস। রয়েছে কত ঐতিহ্য। চারিদিকে বয়ে চলা বাতাস যেন দূর করে দিচ্ছে তার সকল ক্লান্তি। মুছে দিচ্ছে সকল জমে থাকা চাপা কষ্ট। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে সে কী যেন একটা পেয়ে গেছে। যা তার হৃদয়কে পুলকিত করে তোলছে। কিন্তু কী সেই জিনিস? কী সেই অদৃশ্য বস্তু? যা তার মনকে শীতল করে দিচ্ছে। তা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলছে সম্মুখ পানে।
সন্ধ্যার সময় হচ্ছে। আকাশে কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। বিজলী চমকানো শুরু হয়ে গেছে। যেকোন সময় ভারী বৃষ্টি এসে যেতে পারে। তখনি স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে ঘোষনা দিচ্ছে। যেকোন সময় ঝড় আসতে পারে, সবাই নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে।
এদিকে সাগরের উত্তাল বেড়ে গেছে। একটু আগের মন মাতানো জোয়ার ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। সবাই দৌড়ে চলে যাচ্ছে নিরাপদ গন্তব্যের দিকে। আবিরও পানি থেকে হাটা ধরেছে হোটেলের দিকে। তখনি সে দেখে একটি মেয়ে নিরাপদ জায়গার দিকে না গিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা জোয়ারের দিকে।
আবির ঝাপটি মেরে মেয়েটির হাত ধরে বলেঃ এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? এখন এইদিকে যাওয়া নিরাপদ নয়। সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাচ্ছে। মেয়েটি ঝাড়ি মেরে আবির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললোঃ আমি যেখানে যাইনা কেন, তাতে আপনার কি হয়েছে? আবির বললোঃ আপনি এখনি আমার সাথে না ফিরলে পুলিশ ডাকবো। মেয়েটি বললোঃ আপনার যা খুশি করেন। আজ আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। আমি মরেই যাবো।
আবির বিষয়টি বুঝতে পেরে মেয়েটির হাত পুনরায় ধরে টেনে একটি রেস্তোরার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললোঃ মারা যাবেন ভালো কথা। আগে কেন মারা যাচ্ছেন সেটি আমাকে বলে যেতে হবে। মেয়েটি নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার সাথে সাথে বলতে লাগলো " ছাড়েন আমার হাত, নয়ত আমি মানুষকে ডাকবো"। আবির বললোঃ এটি ভালো আইডিয়া, আপনি মানুষকে ডাকেন। এখানে মিডিয়া আছে, যেটি শুধু আমার জানার কথা। সেটি সারা দুনিয়া জানবে। তখন আপনার মান সম্মান আর কিছুই থাকবেনা। সব ধোলোয় মিশে যাবে। তখন মরেও শান্তি পাবেননা। মানুষ আপনাকে ঘৃণা করবে।
এবার মেয়েটি শান্ত হলো, বললোঃ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি শুধু আপনাকে বলবো। এরপর কিন্তু আমাকে পানিতে যেতে দিতে হবে। আবির বললোঃ ঠিক আছে। এরপর তাঁরা প্রবেশ করলো একটি রেস্তোরাতে।
ততক্ষণে বৃষ্টি এসে গেছে। বাতাসের গতী বেড়েই চলছে। আকাশের গর্জন মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলছে। আবির মেয়েটিকে নিয়ে একটি নিরাপদ জায়গায় বসলো। এরপর বললোঃ এবার বলুন আপনি কেন মরতে চাচ্ছেন? কেন আপনি আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও এই কাজ করতে যাচ্ছেন? তখন মেয়েটি বললোঃ আজ আমার ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি। আমার বাবা-মা ডাক্তার। আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই শিক্ষিত। আমি কখনো শুনিনি আমাদের কেহ কখনো পরীক্ষায় ফেল করেছে। আমিও ইতিপূর্বে কখনো ফেল করিনি। আমি কীভাবে আমার মা-বাবাকে এই মুখ দেখাবো? কীভাবে আত্মীয় স্বজনের সামনে যাবো? এই লজ্জার জীবন থেকে না বাচাই ভালো। এই বলে মেয়েটি কাঁদতে লাগলো। আবির মেয়েটির দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিতে দিতে তার মায়াবী অবুজ মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
কিছুক্ষণপর আবির বললোঃ আপনি কি জানেনা এই দুনিয়ার সামান্য ক'দিনের কষ্ট থেকে বাঁচতে আপনি ঝাপ দিচ্ছেন চিরকালের কষ্টের দিকে? আপনি কি জানেনা আত্মহত্যাকারীদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে? মেয়েটি বললোঃ না! আমি এটা জানিনা। তাছাড়া এর বিকল্প কিছুই আমি দেখছিনা।
আবির বললোঃ কে বলছে এর কোন বিকল্প নেই। আপনি বলেছেন আপনার পরিবারের সবাই শিক্ষিত। তারাতো এই জিনিস সহজেই বুঝবে। জীবনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেকারো জীবনে ঘটতেই পারে। আর যদি তাঁরা না বুঝেন তবুও তো কোন সমস্যা নেই। আপনি এখন থেকে পড়ায় আরো মনোযোগি হবেন। ভালো করে লেখাপড়া করে সামনের পরীক্ষায় ভালো রিজাল্ট করে তাদের মুখে হাসি ফুটাবেন। আপনি জীবনে ভালো কিছু করলে দেখবেন তাঁরা আপনাকে নিয়ে গর্ব করবে। পাড়া প্রতিবেশি সবাই আপনাকে ভালোবসবে। সম্মান করতে শুরু করবে।
মেয়েটি বললোঃ আমি চাকরি করতে চাইনা। আমি ভালো কিছু কীভাবে করবো? আবির বললোঃ তাহলে আই ঈ এল টি এস করে বিদেশ চলে যাবেন। মেয়েটি বিদেশে আমি কোথায় যাবো? আবির বললোঃ তা অনেক দূরের পথ। সেটিও প্রয়োজনে আমি বলে দিবো। এবার বাড়ি ফিরেন, নিজেকে ভালোবাসেন। নিজেকে এই দুনিয়ার সামান্য ক'দিনের কষ্টের জন্য চিরদিনের কষ্টে ফেলবেন না।
মেয়েটি এবার যেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলো। তার বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাওয়া কালো মুখটি আলোকিত হয়ে উঠলো। সে বলে উঠলো " আমি বাঁচবো "। মেয়েটির আনন্দিত মুখ দেখে নিজের অজান্তে আবিরে চোখে আন্দদের অশ্রু এসে গেলো। মেয়েটি তা লক্ষ্য করলো। বললোঃ এই আপনি কাঁদছেন কেন? আবির তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে মুচকি হাসি দিয়ে বললোঃ না তো! আমি কাঁদছিনা। চলেন আপনি বাড়ি যাবেন।
তখন আবার মেয়েটির মুখ কালো হয়ে গেলো। সে যেন কোন এক চিন্তায় পড়ে গেছে। আবির তা বুঝতে পেরে বললোঃ আপনি কি চিন্তা করছেন? আপনার বাসা কোথায়? মেয়েটি বললোঃ আমার বাসা সিলেট। আবির বুঝতে পারলো এই রাতে ঝড়ের মধ্যে মেয়েটি একা এতদূর যাবে কীভাবে তা নিয়ে ভাবছে। হয়ত আবেগে বশে এতদূর পাড়ি দিয়ে এসেছে। ভেবেছে দূরে গেলে তার কথা জানবেনা। সে হারিয়ে যাবে সবার অগোচরে।
আবির তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বললোঃ আমি আবির। আমার বাসাও সিলেটে। চলেন আমিও চলে যাবো আপনার সাথে। এবার মুখটি উজ্জল হয়ে গেলো। সেও হাসি দিয়ে বললোঃ হুম! তাহলে চলেন, যাওয়া যেতে পারে। আবির হোটেল থেকে নিজের ব্যাগ নিয়ে রেল স্টেশন থেকে টিকিট কেটে দু'জনই রাতের ট্রেনে যাত্রা শুরু করলো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
যাত্রা পথে তাদের দু'জনের বহু কথা হলো। আবির জেনে নিলো মেয়েটির নাম। মেয়েটির নাম তায়্যিবা। যেমন নাম তেমনি মনটিও পবিত্র। কত সহজ সরল মেয়েটি। সামান্য আবেগ মেয়েটিকে আজ কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো। না! এসব আর ভাবতে হবেনা। মেয়েটি এখন বাঁচবে। নতুন করে জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখবে। তা ভাবতেই আবিরের মন আনন্দে ভরে উঠলো।
রাত পেরিয়ে প্রভাত হয়ে গেলো। ট্রেনের হরণের আওয়াজ দু'জনকে জাগিয়ে তুললো। ট্রেন স্টেশন এসে গেছে। আবির তায়্যিবাকে নিয়ে নেমে গেলো ট্রেন থেকে। আবির বললোঃ চলেন নাস্তা করে নেই, এরপর যাওয়া যাবে বাসায়। তায়্যিবা হুম! বলে চলতে লাগলো আবির সাথে রেস্তোরার উদ্দেশ্যে। নাস্তা শেষে আবির বললোঃ এবার আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেয়া যাক। তায়্যিবা বললোঃ এখন বাবা-মা অনেক দুশ্চিন্তায় থাকবেন। তাঁরা আপনাকে আমার সাথে দেখলে উপস্থিত রাগের বশে আপনার কোন ক্ষতি করে ফেলবেন।
আবির বললোঃ অসুবিধা নেই! বাসা থেকে একটু দূরে থাকতেই আমাকে বলবেন, আমি চলে যাবো। এখন আপনাকে এভাবে ছেড়ে দিলে আজীবন আমার দুশ্চিন্তা থাকবে। তায়্যিবা এবার আবিরের দিকে মুচকি হাসি দিয়ে বললোঃ তাই নাকি? আবির হাসি মুখে বললোঃ হ্যাঁ, তাই। চলেন বাসায় যাই।
গাড়ি করে দু'জন বাসার কাছেই এসে পোঁছাল। একটু দূর থেকে তায়্যিবা আবিরকে আঙ্গুল দিয়ে বললোঃ ওই যে! দু'তালার বারান্দায় বাবা পায়চারি করছেন। খালা মায়ের মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। তখন আবির বললোঃ এবার গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া যাক। গাড়ি থেকে নেমে আবির বললোঃ দেখলেন তো মা-বার অবস্থা কী হয়েছে এক রাতে। আপনার কিছু হলে উনারা বাকি জীবন বাঁচতেন কী করে?
তায়্যিবা সবকিছু বুঝতে পারলো। আবিরকে বললোঃ আর কখনো এমনটি করবোনা। এখন বুঝতে পারছি সবকিছু। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য। আবির মুচকি হাসি দিয়ে বললোঃ আচ্ছা! এবার আপনি যান বাবা-মায়ের কাছে। আমি এখান থেকে আপনার ঘরে পৌঁছা পর্যন্ত দেখবো।
তায়্যিবা আবিরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় বললোঃ আপনার নাম্বারটি কি দেওয়া যাবে? আবির মুচকি হেসে বললোঃ কেন? তায়্যিবা লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বললোঃ মনে আবার কোন দুষ্টুমি বুদ্ধি এলে আপনার কাছ থেকে বুদ্ধি নেবো। আবির তায়্যিবার মোবাইলে নিজের নাম্বার তোলে দিলো। অতঃপর তায়্যিবা চলে গেলো বাসায়। আবির অশ্রু চোখে তাকিয়ে রইলো তায়্যিবা ঘরে পৌঁছা পর্যন্ত। তায়্যিবা বাসায় যেতেই তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। সে আবিরকে ইশারা দিলে, আবির চলে যায় আসে বাড়িতে। তায়্যিবা মা-বাবাকে পুরো ঘটনা খোলে বলে। মা-বাবা ছেলেটির পরিচয় জানতে চাইলে তায়্যিবা বলেঃ আমি পরিচয় জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, তিনি চলে গেছেন।
দুই বছর হয়ে গেছে । তায়্যিবা আবিরের কথামতো আই ঈ এল টি এস দিয়ে সেভেন পয়েন্ট পেয়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কানাডায় চলে যাবে। সে তাঁর বাবামাকে বলে। বাবা-মা বলেনঃ তুমি কানাডায় গিয়ে কোথায় থাকবে? তারচেয়ে তোকে বিয়ে দিয়ে দেই কোন কানাডার ছেলের সাথে অথবা কোন বিত্তবান ছেলে দেখে। তায়্যিবা কিছু না বলে চলে গেল তাঁর রুমে। বাবা-মা শুরু করেন ছেলে দেখা। কিন্তু কোন পাত্রকেই তায়্যিবা পছন্দ করেনা।
একদিন তায়্যিবা ফোন দেয় আবিরের মোবাইলে। আবির ফোন দিয়ে সালাম করে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসছেনা। শুধু কোন মেয়ে কণ্ঠের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে। আবির কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বললোঃ তায়্যিবা?
তায়্যিবা কান্না স্বরে বললোঃ আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন? যদি আমাকে এতো মনে রাখেন, তবে সেদিনেরপর আর কোন খোঁজ নিলেন না কেন? আবির বললোঃ সেদিন আমি তোমার নাম্বার নেওয়ার কথা ভুলে গেছি। পরে তোমাকে অনেক খোঁজেছি। একদিন গিয়েছিলাম তোমাদের বাসায়। একজন লোক বললোঃ উনারা এই বাসা ভাড়া দিয়ে অন্য বাসায় চলে গেছেন।
তায়্যিবা বললোঃ বাসায় আমার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। আপনি এই ঠিকানায় প্রস্তাব পাঠান। আমি সকল প্রস্তাব না করে দিচ্ছি। এভাবে বেশিদিন না করা যাবেনা। পরে বাবা-মা জোর করে কোথাও দিয়ে দিবে। এই বলে সে ঠিকানা মেসেইজ দিয়ে আবিরের মোবাইলে পাঠিয়ে দিলো।
আবির উপস্থিত এত দ্রুত কীভাবে কী করবে তা জানালো তায়্যিবাকে। তায়্যিবা বললোঃ তোমার ওসব ভাবতে হবেনা। আমরা বিয়ের পর কানাডায় চলে যাবো। আবির তায়্যিবার কথা শুনে বললোঃ কানাডা! কীভাবে? তায়্যিবা বললোঃ কেন? তুমি না বলেছিলে আমি আই ঈ এল টি এস দিবো। আমি তা দিয়েছি আর পরের সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি যে, আমরা কানাডায় বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো।
আবির তায়্যিবার জোরাজোরিতে তাঁর মামাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠালো। তায়্যিবার বাবা আবিরের পরিচয় জেনে বললেনঃ জনাব! আপনার ভাগ্নের সাথে আমার মেয়েকে দেওয়া যাবেনা। কারণ আপনার ভাগ্নে ফ্রীল্যান্সিং করে। আমার মেয়েকে আমরা ফুলের মত রেখেছি। ওর অনেক চাহিদা-আবদার রয়েছে। আপনার ভাগ্নে এইসব পূরণ না করতে পারলে ওদের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং এই প্রস্তাব গ্রহণ না করাটাই আমার জন্য ভালো হবে।
আবিরের মামা তায়্যিবার বাবাকে বুঝাতে না পেরে তিনি বিদায় নিয়ে উঠতে যাবেন, তখন তায়্যিবা পাশের রুম থেকে বাবামাকে ডাক দেয়। তাদেরকে বলে ওইদিনের ছেলেটি ছিলো এই আবির। যার জন্য তোমাদের মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। আর তাঁর জন্যই আমি এতদূর আসতে পেরেছি। তায়্যিবার বাবা বললেনঃ তুমি না বলেছিলে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছো। তায়্যিবা বললোঃ সেদিন আমি আপনাদের থেকে লুকিয়েছিলাম, কারণ আমি জানতাম তোমরা থানায় জিডি করেছিলে। আমি যদি তাঁর নাম বলে দিতাম, তাহলে ওকে অনেক সমস্যার সম্মুখিন হতে হতো। আমি তাকে কষ্ট দিতে চাইনি, তাই আপনাদের বলিনি। তায়্যিবার বাবা সাথে সাথে আবিরের মামাকে থামিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে নিলেন।
আজ তায়্যিবা আবিরের বিয়ে। বিয়ে পারিবারিকভাবে হয়েছে। আবির বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে সালাম দিয়ে। তাঁর সামনে লাল ঘুমটা দিয়ে মুখ ঢেকে এক অপ্সরী। যে বিদ্যুতের মত এসে দ্রুত হারিয়ে গেছে। সে ঘুমটা সরাতেই তায়্যিবা আবিরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আবির তায়্যিবার চোখ মুছে দিতে দিতে বলেঃ আমি আর তোমাকে কোথাও হারিয়ে যেতে দিবোনা। তোমাকে আগলে রাখবো সারা জীবন আপন করে।
তুমিও পারবে


বন্ধুর আবদার


বিষাদ আনন্দে রূপ নিয়েছে

