প্রথমে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যিনি রহমান ও রহীম, যার রহমত অফুরন্ত ও অসীম। যিনি আমাদের উপর অনুগ্রহে বেহিসাব নেয়ামত দান করেছেন।
দুনিয়া ও আখেরাতের জিন্দেগীতে মানুষের মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে বহু নিদর্শনাবলী পাঠিয়েছেন। হযরত আদম আলাইহিস সাল্লাম থেকে নিয়ে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। সময়ে সময়ে আদেশ নিষেধ সম্বলিত সহিফা ও কিতাব অবতরণ করেছেন। এতসব কিছুর লক্ষ্য একটাই দুনিয়ার নফছ ও শয়তানের ফাঁদ এড়িয়ে এক আল্লাহর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে মানুষ। যাতে আল্লাহ তাআলার আদেশ নিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু কোনটি যে তামাম জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার আদেশ ও নিষেধ। এই নগন্য জ্বীন ও ইনসান সম্প্রদায়ের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তাহলে এখন উপায় কী হবে। এরই ধারাবাহিকতায় আখেরি উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহারস্বরূপ, অবতীর্ণ করা হলো আল- কোরআন।
এই কিতাব অবতীর্ণ করা হয় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর উপর। এই আল-কুরআনকে বলা হয় আদর্শ জীবন বিধান। তাছাড়া কুরআন তেলাওয়াত ও নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও কোরআন ছাড়া শুদ্ধ হয় না। শুধু তাই না জীবনের সফলতাও সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃতোমাদের মাঝে আমি এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যা ধরে থাকলে আমার পড়ে কখনো তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল আমার সুন্নত ও আল- কুরআন।
"কুরআনের পরিচিতি"
কুরআন কি?
কোরআন বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ। মহান আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে মানব জাতির পথ নির্দেশের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মূল উৎস। পবিত্র কোরআনের উপর ইসলামের পরিপূর্ণ কাটামু ভিত্তিশীল। ইসলামী মূলনীতি নিয়ম কানুন সংক্রান্ত যে কোন বিষয় কুরআন পাকে আলোচনা করা হয়েছে। এবং তা দলিল বলে স্বীকৃত। আল্লাহ তাআলার আদেশ, জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট প্রেরিত নির্দেশাবলীর সংকলন হচ্ছে আল- কুরআন।
কুরআন শব্দের আভিধানিক অর্থঃ
আরবি কুরআন শব্দটি কারাআ ইকরায়ু এর মছদার। সেই হিসাবে কুরআনের অর্থ পাঠ করা। তাই একে কুরআন বলা হয়েছে।
কুরআনের পারিভাষিক অর্থঃ
কুরান ওই কিতাব কে বলা হয়।যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি নাযিল করা হয়েছিল। এবং কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর তা ধারাবাহিকের সাথে সন্দহীন ভাবে বর্ণিত হয়ে আসছে।
কুরআনের নামকরণঃ
কুরআন মানে পাঠ। পাঠ করা হয়েছে, বা পঠিত। যেহেতু কুরআন অন্যান্য গ্রন্থের মত এক সাথে অবতীর্ণ হয়নি। বরং পূর্ণ 23 বছরে আল্লাহর পক্ষ হতে হযরত জিব্রাইল আলাই সাল্লাম। তার নির্দেশে হযরত মোহাম্মদ সাঃ এর নিকট প্রয়োজন অনুসারে পাঠ করে শুনিয়েছেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মানুষকে পাঠ করে শুনিয়েছেন। যা আজও মানুষ পাঠ করছে। এবং কিয়ামত পর্যন্ত পাঠ করবেন। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে 'কুরআন' ।
কুরআন মাজীদ এর নাম সমূহঃ
১/ আল কুরাআন
২/ আল কিতাব
৩/ আল জিকির
৪/ আল ফুরকান
৫/ আল নেয়ামত
৬/ আল নূর
৭/ আল কারীম
৮/ আল হিকমত
৯/ কালামুল্লাহ
১০/ আল হুকমু
১১/ আল সিরাত
১২/ আল হক
১৩/ আল তানজিল
১৪/ আল মাওইজা
১৫/ আহসানুল হাদিস
১৬/ আল হুদা
১৭/ আল ইলিম
১৮/ আল ওহী
১৯/ আল বাসির
২০/ আল কাওলু
ইত্যাদি আরো অনেক নাম রয়েছে।
কুরআন অবতরণের সময় ও পদ্ধতিঃ
মহাগ্রন্থ কুরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়। বরং এটা মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক, জীবন ব্যবস্থা সম্বলিত একটি ঐশী গ্রন্থ। কুরাআন পাক লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত। এ সম্পর্কে কুরআনে এরশাদ হয়েছেঃ বরং এ মহামান্বিত কুরআন লাওহে মাহফুজে সুরক্ষিত। লাওহে মাহফুজ হতে পবিত্র রমজান মাসে "লাইলাতুল কদর" এর রাতে বা মহামান্বিত রাতে। সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কুরআন পৃথিবীর প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়েছে।এ কুরআন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমাম্বয়ে অবতীর্ণ হতো।
ওহীর অর্থঃ
ওহী শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- গোপনে সংবাদ দেওয়া অন্তঃকরণে কোন ভাব সৃষ্টি এবং ইঙ্গিত দান করা কেউ ওহী বলে।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ওহী হচ্ছেনবীদের উপর আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে অবতারিত বাণীকে ওহী বলে।
ওহীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ
আল্লাহ তা'আলা মানব জাতিকে তার প্রতিনিধি হিসাবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর পৃথিবী হলো মানবজাতির জন্য পরীক্ষাগার। এখানে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নিয়ামত রাজি উপভোগ করে তার ঐ আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হয়। এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে দূরে থাকতে হয়। তাই তাকে জানতে হয় কোনটি আল্লাহর সন্তুুষ্টির পথ। এবং কোনটিতে রয়েছে তার অসন্তুুষ্টি। মানুষ সাধারণত তিনটি মাধ্যমে কোন কিছু জানতে পারেঃ1 পঞ্চ ইন্দ্রিয় 2 জ্ঞান 3 ওহীর মাধ্যমে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও জ্ঞান এর মাধ্যমে যা জানা যায় তা অত্যান্ত সীমাবদ্ধ। এর মাধ্যমে সব কিছু জানা যায় না। তাই সবকিছু পরিপূর্ণভাবে জানতে হলে ওহীর জ্ঞান জানা অত্যাবশ্যক। কেননা ইন্দ্রিয় ও জ্ঞানের সীমা যেখানে শেষ ওহীর জ্ঞান সেখান থেকেই শুরু। তাই পৃথিবীর পরীক্ষাগার হতে উত্তীর্ণ হয়ে। মানজিলে মাকসুদে পোঁছতে হলে ওহীর জ্ঞান অপরিহার্য।
ওহীর প্রকারভেদঃ
ওহী সাধারণত দুই প্রকার-১.ওহীয়ে মাতলু বা পঠিত ওহী।২.ওহীয়ে গায়রে মাতলু বা অপঠিত ওহী।( ১) যে ওহীর ভাব ও ভাষা আল্লাহর পক্ষ হতে। হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে রাসুল সাঃ এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। তাকে ওহীয়ে মাতলু বলে। (২) যে ওহীর মর্মার্থ আল্লাহর কিন্তুু ভাসা রাসুল সাঃ এর। তাকে ওহীয়ে গায়রে মাতলূ বলে। তাই হাদিস বা সুন্নাহ হল ওহীয়ে গায়রে মাতলু। আর কুরআন হলো ওহীয়ে মাতলু।
ওহী অবতরণের পদ্ধতিঃ
সত্যের জ্ঞানের প্রধান উৎস ওহী। আল্লাহ তাআলা মহানবী সাঃ এর উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে ওহী অবতীর্ণ করেছেন। হাদীস শাস্ত্র পর্যালোচনা করে ওহী অবতরণের যে সকল পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয় তা হচ্ছে-ঃ
(১) ঘন্টার ধ্বনির মতো এক ধরনের ওহী। ঘনটা যেমন বিরতিহীনভাবে বাজতে থাকে ওয়াহি এর ঘন্টা ও তেমনি। এ ধরনের ওহী নাযিল হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কষ্ট অনুভব করতেন। ওহী নাযিলের সকল পদ্ধতির মধ্যে এটাই ছিল সর্বাধিক কষ্টকর।
(২) কখনো কখনো রাসূল সাঃ এর ঘুমন্ত বা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ওহী নাযিল হতো। আর রাসূল সাঃ এর স্বপ্ন সাধারণ লোকের জাগ্রত অবস্থায় বাস্তব ঘটনা স্বচক্ষে দেখার চেয়েও সত্য।
(৩) কখনো কখনো হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের আকৃতিতে ওহী নিয়ে আসতেন। যেমন রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় হযরত দাহিয়াতুল কালবী (বিখ্যাত সাহাবী) এর আকৃতিতে আমার নিকট ওহী নিয়ে আসতেন।
(৪) কখনো কখনো হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রকৃত আকৃতিতে ওহী নিয়ে আসতেন।
(৫) কোন কোন সময় পর্দার আড়াল হতে আল্লাহ তা'য়ালা সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কথা বলেছেন। এ প্রকারের ওহীতে তাদের মাঝে কোন মধ্যস্থতাকারী ছিলনা।
(৬) মাঝেমাঝে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ হতে সরাসরি ওহী উদয় হতো। রাসুল সাঃ আল্লাহর প্রদত্ত ওহীকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতেন।
(৭) হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যম ছাড়া। সরাসরি আল্লাহর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম কথা বলতেন। এ পদ্ধতিতে মেরাজের রাতে মহানবী সাঃ ওহী লাভ করেছিলেন। তাছাড়া কোনো কোনো সময় হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবর্তে। হযরত ইসরাফিল আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নিকট ওহী নিয়ে আসতেন।
ওহী লেখকদের নামঃ
রাসূল সাঃ এর ওহী লেখার কাজ যারা আঞ্জাম দিয়েছেন। তাদের সংখ্যা কোন কোন মুফাসসির 40 পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেনঃ হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক, হযরত ওমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত জুবায়ের, হযরত আলী, হযরত আমের ইবনে ফুহাইরা, আমর ইবনে আস, উবাই ইবনে রাবী, মুগীরা ইবনে সুবা, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা,খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, সাঈদ ইবনে আস, মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান, যায়েদ ইবনে সাবেত, তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, মুয়াইকিব দাউসী, হুজাইফা ইবনে ইয়ামান, হোয়াইতিব ইবনে আব্দুল উজ্জা, রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুম আনহুম।
কুরআন সংকলন করা ও তার হেফাজতের ইতিহাসঃ
এ কুরআন কারীম লিখে একত্র করা হয়েছে প্রথমবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে। দ্বিতীয় বার হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে। তৃতীয় বার হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে।
রাসুলের যুগে কোরআন হেফাজতের পদ্ধতিঃ
কুরআন কারীম যেহেতু একসাথে অবতীর্ণ হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনানুসারে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়েছে। সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। তাই রাসূল সাঃ এর যুগে কোরআন হেফাজত ও সংরক্ষণের জন্য মুখস্ত করে নেওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। প্রথম পর্যায়ে যখন ওহী অবতীর্ণ হত। তখন রাসূল সাঃ সাথে সাথে তা বারবার পড়তে থাকতেন যাতে তা মুখস্ত হয়ে যায়। একারণে সূরা কিয়ামায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় কুরআন মুখস্থ করার জন্য বারবার পড়ার দরকার নেই।বরং আমি নিজেই তা মুখস্থ করিয়ে দিব। এবং আপনার হৃদয়ে গেঁথে দিবো অর্থাৎ আপনাকে এমন মুখস্থ শক্তি দান করা হবে যে। একবার ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর আপনি তা কখনো ভুলবেন না। সুতরাং তাই হলো, একদিকে ওহী নাযিল হতো অন্যদিকে তা মুখস্ত হয়ে যেত। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম কে কোরআন মুখস্থ করিয়ে দিতেন। আর যখন কোনো ব্যক্তি হিজরত করে মদীনায় আসতো। তখন তিনি তাদেরকে সাহাবাদের নিকট পাঠিয়ে দিতেন কুরআনের মু জন্য। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যে সাহাবায়ে কেরামের এক বিশাল জামাত কোরআন হাফেজ হয়ে গেলেন। সেই যুগে যেহেতু আরবদের নিকট কাগজের প্রচলন ছিল না খুব কম ছিল। এ কারণে কুরআন কারীমের বেশিরভাগ আয়াত পাথরের উপর, চামড়ার উপর, খেজুর গাছের খুলের উপর, বাঁশের উপর, হাড়ের উপর, এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর যামানাতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর তত্ত্বাবধানে কুরআনে কারীমের একটি খন্ড লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। যদিও তা বিন্যস্ত আকারে ছিল না।
হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে কুরআনের সংকলনঃ-
যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জামানা কুরআন কারীম কিতাব আকারে সংকলিত ছিল না ।এবং সাদা পাথরের টুকরায়, চামড়ার উপর, বাঁশের উপর, এবং খেজুর গাছের ডালের মধ্যে লিপিবদ্ধ ছিল। তাই ওই সময় কুরআন কারীম হেফাজত করতে বেশি নির্ভর করা হতো হাফেজে কুরআনদের উপর। হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক রাঃ এর খেলাফতকালে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার মুসাইলামাতুল কাযযাব এর বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক সাহাবী শহীদ হলেন ।এর মধ্যে 70 জন হাফেজে কুরআন সাহাবী ছিলেন। হাফেজী সাহাবীদের শাহাদাতের কারণে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এই ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যদি এভাবে হাফেজ সাহাবীরা শহীদ হতে থাকেন। তাহলে কুরআনের বিরাট একটি অংশ আমাদের থেকে হাতছাড়া হয়ে যাবে।অতএব কুরআন এভাবে শুধু হাফেজদের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। বরং পুরো কুরআনে কারীম কে কিতাব আকারে নিয়ে আসা উচি। তাই তিনি হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক রদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট ব্যাখ্যা ভিত্তিক প্রস্তাব পেশ করলে। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর প্রস্তাব এই বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। আমি এমন কাজ করবো না যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম করেননি। কিন্তু হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলে। উক্ত কাজটির উপকারিতা ভালোভাবে বোঝাতে লাগলেন। হযরত আবু বক্কর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বারবার প্রত্যাখন করতে লাগলেন।
একপর্যায়ে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু অনেক ভেবে চিন্তে হযরত ওমর রাঃ এর প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এবং বললেন ওমরের প্রস্তাবের উপর আল্লাহ আমার দিল কে খুলে দিলেন। অর্থাৎ ওমরের প্রস্তাবের যথার্থ আল্লাহ আমার দিলে ঢেলে দিলেন। অতএব তার যে অভিমত আমারও সেই অভিমত। সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম হযরত উমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর প্রস্তাবে একমত হয়ে গেলেন। অতঃপর এ কাজের জন্য ওহী লেখক হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাঃ কে ডেকে বললে। হে জায়েদ তুমি একজন যুবক বুদ্ধিমান, ও সচেতন মানু। তুমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে ওহী লেখার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছো। অতএব তুমি কুরআনে কারীমের আয়াত গুলো সংগ্রহ করে জমা করে দা। হযরত যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এই প্রস্তাবকে প্রথমে প্রত্যাখন করে। কিন্তু তাদের উভয়ের পিড়াপিড়িতে অবশেষে এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।
হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কিভাবে কুরআন সংকলন করেছিলেনঃ
হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাঃ নিজে হাফেজ ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে নিজে নিজের স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে পুরো কোরআন লিখতে পারতেন।এছাড়া শতশত হাফেজে কোরআন উপস্থিত ছিলেন ।তাদের সকলকে নিয়ে কোরআন মাজীদ লিখতে পারতেন ।তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর যুগে যে নুসখা লেখা ছিল হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ঐ নুসখার দ্বারা পুরা কুরআন সংকলন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সর্তকতা অবলম্বন করে কোন একটি পদ্ধতি গ্রহণ করেননি ।বরং তিনি সমস্ত পদ্ধতি কে সামনে রেখে কুরআন সংকলন করেছেন। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তার নুসখার মধ্যে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন আয়াত লিখতেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত আয়াতটি মুতাওয়াতির হওয়ার উপর মৌখিক কিংবা লিখিত সাক্ষী পাওয়া যেত। তাছাড়া রাসুল সাঃ এর যুগে যে নুসখা লেখা হয়েছিল তা বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরামের নিকট সংরক্ষিত ছিল।হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সে সমস্ত নুসখা একত্র করলেন ।এবং সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যার কাছে যত টুকু কুরআনে কারীম ছিল। তিনি সেগুলো একত্র করে নিলেন। যখন কোন সাহাবী তার কাছে কোন লিখিত আয়াত নিয়ে আসতেন। তখন তিনি তা চার পদ্ধতিতে যাচাই করতেন।
১. সর্বপ্রথম তিনি দেখতেন তিনি যেভাবে মুখস্ত করেছেন তার সাথে মিল আছে কিনা।
২. অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে দিয়ে সত্যায়ন করতেন; কারণ ওমর রাঃ হাফেজ ছিলেন।
৩. লিখিত কোন আয়াতকে ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত এই আয়াতের সত্যায়নের উপর দুজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি সাক্ষ্য না দিত যে, তা রাসূলের সামনে লেখা হয়েছিল।
৪. অতঃপর সে আয়াতকে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের লিখিত আয়াতের সাথে মিলনো হত। এভাবে হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কুরআনের একটি নুসখা তৈরি করলেন, কিন্তু নুসখার আয়াতগুলো রাসুল সাঃ এর তারতীব অনুযায়ী লেখা হলেও সূরাগুলো রাসুল সাঃ এর তারতীব অনুযায়ী ছিলনা। এবং সাতকেরাত জমা করা হয়েছিল। যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর প্রস্তুতকৃত নুসখাটি হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট ছিল। তার ইন্তেকালের পর ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট ছিল ।তার ইন্তেকালের পর উম্মুল মু'মিনীন হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা নিকট ছিল। তার ইন্তেকালের পর মারওয়ান ইবনে হাকাম সেই নুসখাটি বিলুপ্ত করে দেন। কারণ তখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর তৈরিকৃত নুসখা চলছিল।
হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে কুরআন শিক্ষাঃ
যখন হযরত উসমান রাঃ খলিফা হলেন তখন ইসলাম আরব থেকে রুম ইরান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এদিকে আজারবাইজান, খোরাসান, বোখারা, সমারকান্দ,তাসখন্দ,তুর্কিস্তান,উজবেকিস্তান,বেলুচিস্তান,আফগানিস্তান,কাজাকিস্তান,কিরগিজস্তান সিজিস্তান, তাজিকিস্তান, সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান মুসলমানরা জয় করতে লাগলো। এবং এসব এলাকার লোকেরা যখন মুসলমান হতে লাগল। তখন তারা বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরাম থেকে বিভিন্ন কেরাত অনুযায়ী কুরআন শিখতে লাগলো। আর প্রত্যেক সাহাবী তার শাগরেদকে এই কেরাত অনুযায়ী কুরআন পড়াতেন। যে কেরাত তিনি নিজে রাসুল এর কাছে পড়েছেন। এভাবে কেরাত গুলো দূর-দূরান্তে পৌঁছে গেল। আর যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের এ বিষয়ে অবগত ছিল যে কুরআন সাত কেরাতের উপর নাযিল হয়েছে। ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মাঝে কেরাতের ভিন্নতার কারণে কোন প্রকারের সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। পরবর্তীতে কেরাতের ভিন্নতা যখন দূর দূরান্তে পৌঁছে গেল এবং লোকেরা কুরআন সাত কেরাতের উপর অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি ভাবে অবগত ছিলনা। বিধায় তাদের মাঝে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়ে গেল। তখন কিছু লোক নিজের কেরাত কে সহীহ এবং অন্যের কেরাত কে ভুল বলতে লাগলো। এর ঝগড়ার দ্বারা লোকেরা একদিকে কুরআনের তথা ধারাবাহিক কেরাত গুলোকে ভুল গণ্য করার অপরাধে লিপ্ত হতে লাগল। অন্যদিকে তা যাচাই করার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'আলা এর প্রস্তুতকৃত নুসখা শুধু মাদিনায় ছিল। এছাড়া কোরআনের নির্ভরযোগ্য কোনো নুসখা ছিল না। শামের লোকেরা উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা এর কেরাত অনুযায়ী কুরআন পড়তো। আর ইরাকের লোকেরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা এর কেরাত অনুযায়ী কুরআন পড়ত।যেহেতু শামের লোকেরা হযরত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এর কেরাতের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ছিল।সে কারণে তারা ইরাকের লোকেদের কে কাফের বলতে লাগলো। মদিনাতেও এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হতে লাগলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা বড় বড় সাহাবায়ে কেরামকে ডেকে পরামর্শ করলেন। পরামর্শে সিদ্ধান্ত হলো যে সকলে মিলে কুরআনের এমন একটি নুসখা তৈরি করতে হবে যা,সকলে পড়বে ও পড়াবে। এবং সাত লুগাতের ছয় লুগাতকেই বাদ দিয়ে শুধু লুগাতে কোরাইশের উপরই কুরআনকে সংকলন করা হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ এবং অন্যান্য জলীলুল কদর সাহাবীদেরকে নিয়ে একটি টিম গঠন করলেন। এবং তাদেরকে দায়িত্ব দিলেন যে, হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা এর কাছে রাখা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা এর প্রস্তুতকৃত নুসখা থেকে এমন একটি নুসখা তৈরি করবেন। যার মধ্যে সুরা গুলো সঠিক ধারাবাহিকতায় থাকবে। এবং কোরআন শুধু লুগাতে কুরাইশ এর উপর বহাল থাকবে। এভাবে কুরআনের একটি কপি তৈরি হলো।
হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে কুরআনের তৈরি নুসখার বৈশিষ্ট্যসমূহ ঃ
১. হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর যুগে প্রস্তুতকৃত নুসখার মধ্যে সুরা গুলো তারতীব অনুযায়ী ছিল। যা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক এর জমানায় প্রস্তুতকৃত নুসখার মধ্যে ছিলনা।
২. কুরআন কারীমের আয়াত গুলো এমন এক লেখা ছিল যে, লেখার ভিতরে কোনো হরফের নুকতাও ছিল না এমনকি যের, যবর, ও পেশ, কিছুই ছিল না।
৩. হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে প্রস্তুতকৃত নুসখাটি পুরো উম্মতের সম্মিলিত সত্যায়নের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছিল। উক্ত নুসখার সংখ্যা ছিল৫টি, আবার কেউ কেউ বলেন সাতটি।
সাতটি নুসখার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলঃ
১. একটি নুসখা মক্কায়,এ নুসখাটি ৬৫৭ হিজরী পর্যন্ত মক্কায় ছিল।
২. একটি নুসখা ছিল শামে।
৩. একটি নুসখা ছিল ইয়ামেনে, ঐতিহাসিকদের মতে এ নুসখাটি মিশরের কুতুবখানা জামে কায়রোর মধ্যে রয়েছে।
৪. একটি নুসখা ছিল বাহরাইনে, ঐতিহাসিকদের মতে এ নুসখাটি ফ্রান্সের কুতুবখানায় রয়েছে।
৫. একটি নুসখা ছিল বসরায়,এ নুসখাটি মিশরের খাদিও নামক কুতুবখানায় ছিল তা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর উজির ৫৭৫ হিজরীতে ৩০ হাজার আশরাফী দিয়ে ক্রয় করে নেন।
৬. একটি নুসখা ছিল কুফায়, এ নুসখাটি কুস্তুনতুনিয়ার কুতুবখানায় রয়েছে।
৭. একটি নুসখা ছিল মদিনায়। এই নুসখাটি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট ছিল।
🌹এই নুসখা গুলো তৈরি হওয়ার পর। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ছোট ছোট যত নুসখা সাহাবায়ে কেরামের কাছে সংরক্ষিত ছিল। সবগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা করে দিলেন। এবং হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর প্রস্তুতকৃত নুসখার উপর সমস্ত উম্মত একমত হয়ে গেল যে। কোরআন কারীম কে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর লিপির বিপরীত অন্য কোন পদ্ধতি লিপির লেখা জায়েজ নেই।
কুরআনকে সাত লুগাতে অবতীর্ণ করার তাৎপর্য ঃ-
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীম কে সাতটি গোত্রের ভাষায় নাযিল করেছেন। যাতে করে কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা সৃষ্টি না হয় এবং সহজেই তেলাওয়াত করা যায়। এজন্য উম্মতে মোহাম্মদীকে কুরআনের শব্দ কে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ অনেক সময় অনেক মানুষ কোন শব্দকে অন্যের মত একই ভাবে পড়তে পারে না। তাই তেলাওয়াতের সুবিধার্থে আল্লাহতালা উম্মতে মুহাম্মদীকে সাতটি পদ্ধতিতে পড়ার অনুমতি দিয়েছেন। যেমন হাদিস শরীফে আছে কুরআন কারীম কে সাত কেরাত এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। অতএব এই সাত পদ্ধতির যে কোন পদ্ধতি তোমাদের কাছে সহজ মনে হয় সে পদ্ধতিতে পড়ো।
কুরআন কারীমের তারতীবঃ-
কোরআন মাজিদের বর্তমান তরতীব লাওহে মাহফূয- এর তারতীব অনুযায়ী,নাজিল হওয়ার তারতীব অনুযায়ী নয়।অর্থাৎ শুরুতেই যখন কুরআনে কারীম লাওহে মাহফুজ থেকে সামায়ে দুনিয়াতে অবতীর্ণ হল। তখন লাওহে মাহফুজ এর তারতীব অনুযায়ী অবতীর্ণ হয়েছে। অতঃপর সামায়ে দুনিয়া থেকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী হযরত জিব্রাইল আলাই সাল্লাম তারতীব ছাড়াই, প্রয়োজন অনুসারে কিছু কিছু করে নিয়ে অবতীর্ণ হন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে লিখেয়ে দিতেন বা ইয়াদ করিয়ে দিতেন তখন লাওহে মাহফুজের তারতীব অনুযায়ী ইয়াদ করিয়া দিতেন বা লিখিয়ে দিতেন। স্বয়ং রাসুল সাঃ প্রত্যেক রমজান মাসে হযরত জিব্রাইল আলাই সাল্লাম এর সাথে দাওর করতেন। এবং জীবনের শেষ রমজানেও জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দাওর করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে কুরআনের তারতীব লাওহে মাহফূয এর তারতীব অনুযায়ী হয়ে যায়। সুতরাং বর্তমান কুরআনের তারতীব লাওহে মাহফূয এর তারতীব অনুযায়ী আছে। এবং ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কুরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ার হেকমত বা রহস্যঃ
এ ব্যাপারে মুফাসসিরে কেরাম কয়েকটি জবাব পেশ করেছেন-
১. কুরআন কারীম যদি একসাথে অবতীর্ণ হতো তাহলে কুরআন মুখস্থ করা ও আয়ত্ত করা কঠিন হয়ে যেত।
২. কোরআন যদি একসাথে অবতীর্ণ হত তাহলে কুরআনের হুকুম আহকাম জানা কঠিন হয়ে যেত।
৩. যেহেতু কাফেররা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনেক কষ্ট দিতো, তাই জিব্রাইল আঃ এর বারবার আশা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সান্তনার কারণ হত এবং রাসূল সাঃ এর জন্য কষ্টের মোকাবিলায় ধৈর্য দারণ করা সহজ হতো এবং তার ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পেত।
৪. কুরআনের একটি বিরাট অংশ বিভিন্ন ঘটনা ও প্রশ্ন প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং সমীচীন হল যখন ঘটনা বা প্রশ্ন আসবে তখন ঐ আয়াত নাজিল হবে। যাতে করে মানুষ সময় উপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
কুরআনকে 30 পারায় ভাগ করাঃ
কুরআনকে 30 পারায় ভাগ করাটা অর্থের দিক থেকে করা হয়নি; বরং বাচ্চাদের পড়ার সুবিধার্থে কুরআনকে 30 পারায় বন্টন করা হয়েছে। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সর্বপ্রথম কুরআনকে 30 পারায় ভাগ করেছেন।
কোরআন মাজিদের হরফের সংখ্যাঃ
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তৎকালীন সমস্ত হাফেজ কারিও কাতেবদেরকে ডেকে কুরআনের হরফ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা ভালো করে গুনে সর্বসম্মতভাবে রায় দিলেন যে, কুরআনের হরফ সংখ্যা হল তিন লক্ষ 40 হাজার সাতশত 4 সংখ্যা।
সর্বপ্রথম কোরআন নাজিল হওয়ার সময় ও স্থানঃ
কোরআন সর্বপ্রথম 17 ই রমজান 610 খ্রিস্টাব্দে 17 ই আগস্ট রোজ সোমবার হেরা গুহায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নাযিল হয়। পুরা কুরআন নাযিল হতে সময় লেগেছে 22 বছর পাঁচ মাস 14 দিন। পবিত্র কুরআন সংরক্ষিত আছে লাওহে মাহফুজে। পবিত্র কুরআনের হেফাজতকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।
কুরআন পাকের বিষয়বস্তুঃ
পবিত্র কুরআন হলো মহান আল্লাহর অমীয় বাণী যা আশরাফুল মাখলুকাত ও আল্লাহর খলিফা মানব জাতিকে হেদায়েতের সরল-সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। মানুষকে লক্ষ্য করেই পবিত্র কুরআনের সকল আলোচনা কেন্দ্রীভূত। তাই পবিত্র কুরআনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হলো, মানুষ এবং মানুষের পার্থিব ও পরকালীন জীবন। কোরআনের বিষয়বস্তু পাচঁ শ্রেণীতে বিভক্ত যথাঃ-
১/ শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কিত জ্ঞানঃ মানব জীবনের আবশ্যকীয় হুকুম আহকাম ও আদেশ নিষেধ কুরআনের আলোচ্য বিষয়। ফরজ ওয়াজিব, হালাল, হারাম, ইত্যাদি সম্পর্কে এতে আলোচিত হয়েছে। কুরআনে আছে যেমনঃ তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং যাকাত আদায় করো।
২/ ভ্রান্তির পন্থীদের আকিদা খন্ডন ও তাদের সাথে বিতরকের জ্ঞানঃ সমকালীন বিশ্বে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আদর্শ।যেমনঃ ইহুদি, খ্রিষ্টান ও কাফের, মুশরিক ইত্যাদি মতবাদের সকল প্রশ্নের জবাব এতে দেওয়া হয়েছে। কোরআনে আছে যেমনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা করছ সব কিছু।
৩/ পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনাবলীঃ পবিত্র কুরআন ইতিহাস শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠতম নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। অসংখ্য ঐতিহাসিক কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে এতে নৈতিক উপদেশ প্রদান করা হয়েছে।
৪/ আল্লাহর নেয়ামত রাজি ও নির্দেশনাবলী সংক্রান্ত জ্ঞানঃ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত ছড়িয়ে আছে। এসব নেয়ামত রাজির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরআনে। যেমনঃ হে ঈমানদারগণ আমি তোমাদেরকে যে সকল পবিত্র বস্তু জীবিকা রূপে দান করেছি, তা হতে ভক্ষণ করো এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। যদি তোমরা একান্তভাবে তারই ইবাদত করো।
৫/ মৃত্যু পরবর্তী কালীন যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানঃ মানুষের জন্য পৃথিবীর এই জীবনী শেষ নয় বরং মৃত্যুর মাধ্যমে শুরু হবে তার প্রকৃত জীবন পরকাল বা আখেরাত। এতে আখেরাতের বিভিন্ন পর্যায় কবর, হাশর,পুনরুত্থান, হিসাব, নিকাশ, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। যেমন কুরআনে আছেঃ আজ কারো প্রতি একবিন্দু জুলুম করা হবে না। আর তোমাদেরকে তেমন প্রতিফল দেয়া হবে যেমন তোমরা আমল করেছিলে। আরো একটি আয়াতে আছেঃ হে মুহাম্মদ আপনি তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করুন যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে। নিশ্চয়ই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার তলদেশে দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত।
মক্কী মাদানী সূরাঃ
হিজরতের পূর্বে যেসব সূরা নাযিল হয়েছে সে সূরা সমূহ কে মক্কী সূরা বলা হয়। হিজরতের পর অবতীর্ণ সূরা সমূহ কে মাদানী সূরা বলা হয়।
পবিত্র কুরআনের বৈশিষ্ট্যঃ
১. পবিত্র কোরআনই একমাত্র গ্রন্ত, যা সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে আমি আল্লাহ পাকের কালাম আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।
২.পবিত্র কুরআন সে গ্রন্থ যা বিশ্ববাসীর সম্মুখে এমন এক ব্যক্তি নিয়ে এসেছেন। যিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মানুষ এবং সর্বশেষ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র এবং যার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ।
৩. পবিত্র কুরআন সে গ্রন্থ যা সকল সৎকাজের নির্দেশ দেয়। এবং যাবতীয় মন্দ কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
৪. পবিত্র কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার বিধিনিষেধের উপর সর্বদা সর্বত্র আমল করা হয়। এবং কিয়ামত পর্যন্ত আমল করা হবে।
৫. পবিত্র কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা দ্বারা একজন মহা জ্ঞানী ব্যক্তি এবং একজন সাধারন মানুষ উপকৃত হতে পারেন।
৬. পবিত্র কোরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ পাক স্বয়ং গ্রহণ করেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কুরআনের তরজমাঃ
কোরআন একমাত্র গ্রন্থ যা বহু ভাসায় তরজমা করা হয়। এতেই কুরআনের জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করা যায়। সর্বপ্রথম১১৪৬ সালে লেটিন বাসায় কুরআনের তরজমা করা হয়। তার পরবর্তীতে জার্মানি, গ্রিক, উর্দু, বাংলা, ও ইংরেজি। ইত্যাদি ভাসায় কুরআনের অনুবাদ করা হয়।
"কুরআনের তাফসীর আরম্ভ"
"আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম" অর্থ আমি আল্লাহ তাআলার নিকট অভিশপ্ত শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
শানে নুযুলঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ওহী নিয়ে আসেন, তখন তিনি রাসূল সাঃ কে বলেন আপনি পাঠ করুন- আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম, অতঃপর বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম পড়তে বলেন। তখন রাসূলু সাঃ আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠ করেন। অতঃপর কুরআন অবতীর্ণ হয়।
"বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম" অর্থ-পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
এর বিশ্লেষণঃ
সকল মুসলমান এতে একমত যে এ আয়াতটি কুরআন কারীমের সূরা নামল এর একটি আয়াতের অংশ। আর এতে একমত যে সূরা তওবা ব্যতীত সকল সূরার শুরুতে লেখা হয়। ইমাম আবু হানীফা রাহঃ বলেন বিসমিল্লাহ সূরা নামাল ছাড়া অন্য কোন সূরার অংশ নয়। তবে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আয়াত যা প্রত্যেক সূরার প্রথমে লেখা হয়েছে। (সূরা তওবা ব্যতীত) এবং দুটি সূরার মধ্যে পার্থক্য করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন