ইসলামিক ইতিহাস

সুচিপত্র
 
১/লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
২/হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
৩/মুসলমানদের গৌরব উজ্জ্বল কীর্তি
৪/ভূমিকা
৫/ইতিহাস
৬/ইতিহাসে প্রয়োজন এবং এর উপকারিতা
৭/


ইসলামের ইতিহাস 


ইতিহাস হলো জাতির দর্পণ স্বরূপ, এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে

বিগত দিনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিকথা। আর জানতে পারে এর কারণ সমূহ।

তাই মানুষ ইতিহাস পাঠেসাবধানী হয়। ইতিহাস কে জাতির বিবেক বলা চলে।

এটা একটা জাতির দিকদর্শন বলাচলে।

এটা জাতির দিকদর্শন যন্ত্রের মতো কাজ করে।

এই কিতাবটিতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম হতে

  মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনা উল্লেখ আছে।

এবং খোলাফায়ে রাশেদার আমলে ইসলাম প্রচার, দেশ বিজয়, রাজ্য শাসন,

ইত্যাদি বিষয়ের নিখুঁত, নির্ভুল উপস্থাপনার মাধ্যমে। এই কিতাব উপস্থাপন করা হয়েছে।

তাই আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি।

       

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ

বিশ্ব ইতিহাসের প্রতি নজর বুলালে প্রতীয়মান হয় যে।

পৃথিবীর দেশে দেশে যুগে যুগে যত আম্বিয়ায়ে কেরাম সংস্কারক ধর্ম প্রবর্তক এসেছেন।

তাদের সবাই এক মহান সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন।

এবং সকলেই তাদের অনুসারীদেরকে এক  আল্লাহতালার অস্তিত্বে

বিশ্বাসী করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। হযরত আদম আলাই সাল্লাম, হজরত নুহ আলাই সাল্লাম,

হযরত ইব্রাহিম আলাই সাল্লাম, এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম,

এর সময়কাল এর মধ্যে শত শত হাজার হাজার বছরের ব্যবধান দূরত্ব থাকা সত্বেও।

তারা সবাই এক আল্লাহ তাআলার একাততা তথা তাওহিদের মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামঃ

সুবিশাল বায়যাইন্টাইন সাম্রাজ্য শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তার অর্ধপাশবিক আইন কানুন বিকৃত  হয়ে।

তার নিপীরন ও ত্রুটিসমূহকে বাধিত এবং পূর্ব থেকেই যাতে গুনের পরিমাণ ছিল খুবই অল্প।

তা দিন দিন অবলুপ্ত করে ফেলেছিল। ইরানের শাহানশাহে পরিণত হয়েছিল তুর্কিস্তান হয়ে উঠেছিল

রক্তপাতের একটি নিরাপদ ঘাঁটি। ভারতবর্ষে মহারাজা অসুখের এবং রাজা কনিষ্কের যুগের

সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা অবলুপ্ত হয়ে পড়েছিল। মহারাজা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকাল এর কথা

তখন কেউ চিন্তাও করতে পারত না। বৈদ্য রাজত্বের কোন নমুনা তখন বিদ্যমান ছিল না।

আর যারা বৈদ্যের ভক্তি ছিল তাদের অবস্থা এতই শোচনীয় ছিল যে। বিশ্বাস গত দুর্বলতার কারণে

তারা যেকোন কাজ করতে লজ্জা কর বা দ্বিধা বোধ করত না। আর শ্রীকৃষের নাম জপ কারীদের

অবস্থা ছিল এই যে। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে বৃক্ষলতা জড় পদার্থের সামনে অবনত

মস্তকে প্রণিপাত করতে তারা একটুকু দ্বিধা বোধ করত না। ইউরোপ ছিল এক সংকুল বিভীষিকাময় প্রান্তর।

আর তার অধিবাসীরা ছিল রক্তলোলুপ বাঘের চাইতেও ভয়ংকর।

জীব নৈতিকতা অশান্তি বিনষ্টকারী কার্যকলাপের অভয়ারণ্য।

সেখানকার অধিবাসীদের জীবজন্তুর ও অধম জীবন যাপন করত। 

মোটকথা পৃথিবীর কোন দেশে কোন ভূখণ্ডে মানুষ মানবীয় মহত্ব ও গুণাবলী সহ বিদ্যমান ছিল না।

জল স্থল এক করুন পরিবেশ বিরাজ করছিল। যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল।

তখন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই অন্ধকারে আচ্ছন্ন পৃথিবী থেকে।

জুলুম অত্যাচার রক্তপাত থেকে বিরত রাখতে এবং শান্তির জন্য।

আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমস্ত বিশ্বের রহমত স্বরূপ প্রেরন করেন।

মুসলমানদের গৌরব উজ্জ্বল কীর্তিঃ

পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে মুসলমানি একমাত্র জাতি যার রয়েছে সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল।

জাতি তাদের মহৎ ব্যক্তিদের সম্পর্কে এমনই নিশ্চিতভাবে জানতে পারে যা সকল প্রকার সংশয় থেকে মুক্ত।

মুসলমানদের হিন্দুদের রামায়ণ ও নানা প্রকার কাল্পনিক কাহিনী এর প্রয়োজন নেই।

কেননা এসব কল্পকাহিনীর চাইতে অনেক বেশি বিষ্ময়কর ও গৌরব উজ্জ্বল কাহিনীর

বাস্তব উদাহরণ তাদের মুসলমানদের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে।

অথচ তাতে কোন মিথ্যা কল্পকাহিনী নেই। কতই আক্ষেপ আশ্চর্যের ব্যাপার আজ যখন

বিশ্বের জাতি নিজেদেরকে বিশ্ব দরবারে সমুন্নত করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তখন সর্বাধিক

গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকারী মুসলমানগণ। নিজেদের ইতিহাস

সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজের মনের অজান্তের খ্রিস্টান মনীষির নামে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে আসে।

এক্ষেত্রে তার চাইতে হাজারগুন উল্লেখযোগ্য কোন মুসলিম মনীষীর নাম তার জানা থাকে না।

ইউরোপীয় মনীষীর নাম যত নিতে দেখি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, সালাউদ্দিন আইয়ুবী,

হাসান ইবনে সাবিত, ফেরদৌসী, তুষী ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, ওসমান, প্রমুখ মুসলিম

মনীষীর নাম তত নিতে দেখা যায় না। এর একটি মাত্র কারণ আর তা হচ্ছে বর্তমান যুগে

মুসলমানরা তাদের নিজ ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ ও নির্বিকার। এর কারণ হল বর্তমানে সরকারি

কলেজ ও মাদ্রাসা গুলোতে সঠিক ইসলামী ইতিহাস সম্পর্কে কোন কিতাব পড়ানো হয় না।

মোটকথা আমাদের শিক্ষিত মুসলমানদেরকে সেই ইসলামের ইতিহাসের উপর নির্ভর

করতে হয় যা ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রুরা বিকৃত করে তাদের ইংরেজি পুস্তিকাদিতে লিখেছে।

মুসলমানদের ছাড়া পৃথিবীর আর কোন জাতির ভাগ্য হয়নি যে। ইতিহাসকে একটা সঠিক ভিত্তির

উপর রীতিমত একটি স্বাস্থ্যকর করে দাড় করাবে। তাদের কেউই তাদের পূর্বপুরুষদের সঠিক

ইতিহাস রচনায় সমর্থ হননি। মুসলমানরা মহানবী সাঃ এর হাদীস সংরক্ষণ ও

বর্ণনা কঠোর সতর্কতাও নিয়মা কানুন স্বাক্ষর রেখেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো নজির নেই।


               ভূমিকা

   

ইতিহাসঃ

আরবি উর্দু ফার্সি ভাষায় তারিখ, এবং বাংলাতে ইতিহাসের, পরিভাষাগত অর্থ হচ্ছে;

 ওই বিদ্যা যার মাধ্যমে রাজা বাদশা নবী রাসুল বিজেতা ও বিখ্যাত মনীষীগণের জীবন কাহিনী।

এবং অতীত যুগের বড় বড় ঘটনা ও রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়।

এবং যা বিগত যুগ সমূহের সামাজিক নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান

লাভের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আরো সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, যে সকল

অবস্থা ও ঘটননা বলি কাল নির্দেশ করে লিখিত হয় তাকেই ইতিহাস বলা হয়ে থাকে।

ইতিহাসে প্রয়োজন এবং এর উপকারিতাঃ

ইতিহাস আমাদেরকে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদের কাহিনী সমূহ সম্পর্কে অবহিত করে।

আমাদের মন-মস্তিষ্ক কে একটি শুভ উদ্দীপনার সঞ্চর করে।

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ তোমরা যদি না জানো তবে জ্ঞানী দিদিকে জিজ্ঞাসা করো।

  আল্লাহর এই সুস্পষ্ট হুকুম করার মধ্যেই ইতিহাসিক গ্রন্থাদি পাঠে  মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।

আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে সম্মোধন করে কোরআনে বলেছেনঃ হে বনী ইসরাইল স্মরণ

করো তোমাদের পূর্বপুরুষদের কথা। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

তাই আমাদের কে ও আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস পড়তে হবে।


ইতিহাসের মাধ্যমে সামরিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণঃ

যে জাতি নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং অতীতের গৌরবজনক অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য দিও অক্ষুন্ন থাকে। সে জাতির কোন ব্যক্তি অন্য জাতির মোকাবেলায় কোন ক্ষেত্রেই সাহস হারায় না পিছুপা হয়না। বরং আত্মবিশ্বাসের সাথে জাতির গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়। এবং তাতে সাফল্য অর্জন করে। যেমন কোন জাতির একথা জানা থাকবে যে আমার বাপ দাদারা অমুক অমুক যুদ্ধক্ষেত্রে অটল থেকেছেন। কখনো পিছুপা হয়ে পলায়ন করেননি। তখন তারাও বাপ-দাদার স্মৃতি অনুসারে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করবে না। সুতরাং সে জয়লাভ করবে। আর যার যানা থাকবে না সে পলায়ন করবে। সুতরাং সে হারবে। অনুরূপভাবে বিশ্বস্থতা, সত্য ভাষণ, সচ্চরিত্র, লজ্জাশীলতা, দানশীলতা, ইত্যাদি ব্যাপারেও পূর্বপুরুষের ইতিহাস সম্পর্কে অবগতি ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্ভবত এর কারণেই বিভিন্ন জাতি তারা তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস মিথ্যা ও রূপকথা দিয়ে লিখে। তারা একটুকু ভেবে দেখে না যে- এ মিথ্যাচারের মাধ্যমে সত্যের কাঠগড়ায় ঐতিহাসিক দের দরবারে তারা কতটা খাটো হাস্যকর সম্পন্ন হবে।

ইতিহাসবেত্তাঃ

একজন যথার্থ ধার্মিক এবং সঠিক চিন্তাধারা লোকইএকজন সত্যিকারের ইতিহাসবেত্তা হতে পারেন। তিনি শুধু তাই লিখবে যা সত্যি সত্যি ঘটেছে। তিনি কোন কিছু গোপন ও করবেন না বা নিজের পক্ষ হতে কিছু বাড়িয়েও লেখবেন না। যেসব ক্ষেত্রে স্বল্পবুদ্ধির লোকদের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সেসব ক্ষেত্রে তিনি তার নিজের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা অবশ্যই দেবেন। বরং এটা ইতিহাসের একটা দায়িত্ব। ইতিহাসবেত্তা কারো অহেতুক তোষামোদ করবে না। আবার কারো বিদ্বেষ ও করবে না। ইতিহাসবেত্তার বাসা ও বর্ণনা ভঙ্গি হবে একান্ত সাদাসিদে ও সহজ। ইতিহাসবেত্তার জন্য বিশ্বস্থতা হচ্ছে অপরিহার্য গুণ। মিথ্যাচার ও বাচালতা থেকে তাকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে।

ইতিহাস পাঠকঃ

ইতিহাস লেখা বা তার বিন্যাস যেমন একটা সুকঠিন কাজ। তেমনি তা পাঠ করা বা তা থেকে যথার্থ ভাবে উপকৃত হওয়া কোনো সহজ ব্যাপার নয়। ইতিহাস পাঠকের উচিত অতীত ইতিহাসকে শিক্ষণীয় ব্যাপার রূপে গণ্য করা। অতীতকালের লোকদের অনাচার ও ভুল-ভ্রান্তির পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে সে সব থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এবং সদাচারের সফল সম্পর্কে অবহিত হয়ে সেগুলো আত্মস্থ করার জন্য যত্নবান হবে। এবং ভালো যারা ছিলেন আর তারা এই পৃথিবীতে কে চিরবিদায় নিয়েছেন। তাদের জন্য দুয়াআ করা।

ইতিহাসের প্রকারঃ

বিভিন্ন দিক থেকে বিবেচনা করলে ইতিহাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন পরিমাণ পরিমিতির দিক থেকে ইতিহাস দুই প্রকারঃ-

(১) সাধারণ ইতিহাস।(২)বিশেষ ইতিহাস। সাধারণ ইতিহাস, হচ্ছে সেই ইতিহাস যাতে সমগ্র বিশ্বের সমগ্র মানুষের ইতিহাস। আর বিশেষ ইতিহাস, হচ্ছে সেসব ইতিহাস যা কোনো বিশেষ জাতি, রাষ্ট্র বা রাজবংশের ইতিহাস।

আবার অবস্থার দিক থেকেও ইতিহাস দু'রকম হতে পারেঃ-

(১) বর্ণনা ভিত্তিক(২) বুদ্ধি ও অনুমানভিত্তিক। ১,বর্ণনা ভিত্তিক, ইতিহাস হচ্ছে ওইগুলো যাতে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়। এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনা সংঘটিত হওয়ার নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য রেওয়ায়াত ও বর্ণনা ঐতিহাসিকের হস্তগত হয়েছে। অথবা ইতিহাসবেত্তা নিজে প্রত্যক্ষদর্শী রূপে সে ঘটনা দেখেছেন। এ জাতীয় ইতিহাস সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

২, বুদ্ধি ভিত্তিক, ইতিহাস হচ্ছে সেগুলো যা শ্রুতি নির্ভর নিদর্শনাদি। এবং নিছক আন্দাজ-অনুমানের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে। এবং ইতিহাসবেওার বর্ণনাকারীর সমসাময়িক কোন ব্যক্তির বর্ণনা আদৌ হস্তগত হয় না। যেমন প্রাচীন মিশর, প্রাচীন ইরাক, প্রাচীন পারস্য, এইসব ইতিহাস সম্প্রতিকালে লিখিত হয়েছে।এসব ইতিহাস থেকেও কিছু লাভ হয় তাকে। কিন্তু তাতে নিশ্চিত জ্ঞান কোনমতেই অর্জিত হতে পারে না।

ইতিহাসের যুগ সমূহঃ

১. প্রাচীন যুগ

২. মধ্য যুগ

৩. শেষ যুগ

প্রাচীন যুগ হচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে বায়যান্টাইন সাম্রাজ্যের শেষ যুগ পর্যন্ত। মধ্যযুগ হচ্ছে বায়যান্টাইন সাম্রাজ্যের শেষ যুগ থেকে দ্বিতীয় সুলতান মোহাম্মদের যুগে কনস্টান্টিনোপল বিজয় কাল পর্যন্ত যুগ।

ইসলামের ইতিহাসঃ

পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে একমাত্র মুসলিম জাতি এমন একটি জাতি। এবং ইসলাম ধর্ম এমন একটি ধর্ম। যার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। এর কোন একটি অংশ বা অধ্যায়ও এমন নয় যাতে সন্দেহের অবকাশ আছে। মুসলমানরা হুজুর সাঃ এর যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সংঘটিত যাবতীয় ঘটনার বিবরণ লিখিতভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উদাসীনতা প্রদর্শন করেননি। মুসলমানদের জন্য এটা গর্বের কারণ যে- ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রত্যেকটি ঘটনার সমসাময়িক ঐতিহাসিক প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সাহায্যে তারা রচনা করতে পারেন। মোটকথা পৃথিবীতে কেবল মুসলমানরাই এমন একটা জাতি। যারা তাদের পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। দুনিয়ার অন্য কোন জাতি এ ব্যাপারে মুসলমানদের সমকক্ষ নয়।

ইতিহাস যেখান থেকে শুরুঃ

সাধারণত মুসলমান ঐতিহাসিকগণ ইসলামের ইতিহাস হযরত আদম আলাই সাল্লাম থেকে। বরং কেউ কেউ পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে লিখতে শুরু করেন। আমি আমার ইতিহাস হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করছি। কেননা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর পূর্বেকার ইতিহাস সর্বতোভাবে সন্দেহমুক্ত নয়। তার যুগের পূর্বে পৃথিবীর ইতিহাস রচনা তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। সাধারনতো নবী করিম সাঃ থেকে ইসলামের ইতিহাসের সূচনা বলে ধরা হয়। সাধারণত হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে ইসলামের প্রবর্তক বলে মনে করা হয়ে থাকে। এবং তার অনুসারীদেরকে মুসলমান বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর আদি মানব হযরত আদম আলাই সাল্লাম এর সময় থেকেই ইসলাম দুনিয়াতে মজুদ রয়েছে। এবং এভাবেই চলে আসছে।

ইতিহাস ও ভূগোলের পারস্পরিক সম্পর্কঃ

ইতিহাসের সাথে নিঃসন্দেহে ভূগোলের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই সাম্প্রতিককালে ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকদের অনুসরণে যেসব ইতিহাস গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। সেগুলোতে ইতিহাসের সাথে ভূগোল ও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর সীরাত রচয়িতাগন আরব দেশের ভূগোলের ব্যাখ্যা প্রদান, প্রতিপাদ্য বিষয় বুঝবার সুবিধার্থে সন্নিবেশিত করা কে জরুরী জ্ঞান করে থাকেন। কিন্তু আমি যেহেতু ইসলামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে মনস্থ করেছি। তাই ভাবলাম আমি যদি এর সাথে ভূগোল ও জুড়ে দেই তাহলে গোটা বিশ্বের ভূগোলই তাতে সন্নিবেশিত করতে হবে। কেননা মুসলমান এবং তাদের রাজত্ব গোটা বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত। সংক্ষেপে তা গ্রন্থবদ্ধ করা সে কঠিন কাজ। তাই আমাকে এ সুদারনার আশ্রয় নিতে হয়েছে যে। এ গ্রন্থের পাঠক নিশ্চয় ভূগোল সম্পর্কে সাম্যক ওয়াকফিহাল। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানচিত্র নিশ্চয় তাদের হাতের কাছে মওজুদ আছে। তারা তা জোগাড় করে নিতে পারবেন। জাহিলিয়াতের যুগে আরবের বিভিন্ন জাতি যেমন কুরাইশ, জাহেলিয়া যুগের প্রথা পদ্ধতি প্রভৃতি ব্যাপারেও এ গ্রন্থে ততো বিস্তারিত আলোচনা হবে না।

হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জীবনী প্রণয়নে আমি সর্বাধিক নির্ভর করেছি হাদিসের বিখ্যাত ছয় খানি কিতাব সিহাহ সিওাহর উপর। হাদিসের কিতাব সমুহকে এ ক্ষেত্রে ইতিহাস গ্রন্থের উপর প্রাধান্য দিয়েছি।ইতিহাস গ্রন্থ সমূহ থেকে যেগুলো নির্ভরযোগ্য এবং ভালো। সেগুলো থেকে যা সাধারণভাবে বিবৃত হয়েছে তাই লিপিবদ্ধ করেছি। এভাবে ইতিহাসের সর্বোত্তম সারবস্তু লিখে দিয়েছি। এবং আব্বাসী খেলাফত এর দুর্বলতা ও পতনের সূচনায় যেসব দেশে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। সেসবের পৃথক পৃথক ভাবে সমসাময়িক যুগের ঐতিহাসিকদের গ্রন্থি থেকে লিখে দিয়েছি। এবং কোন কোন স্থানে খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের কথা লিখে দিয়েছি। এটা শুধু প্রতিপাদ্য বিষয়ের সত্যতা প্রতিপন্ন করার জন্য আলোচনা করেছি। সাধারণ আমার বিশ্বাস মুসলমানদের ইতিহাস খ্রিস্টানদের ইতিহাস থেকে অত্যান্ত মামুলি ও সত্য। মুসলমান ঐতিহাসিকগণ আল্লাহর ফজলে ও প্রবণতা থেকে অনেকাংশেই মুক্ত। আর এজন্যই তারা বিশ্বস্ত সাক্ষ্যের মতো আমাদেরকে অনেকটা সহায়তা প্রদান করতে পারেন।

ইতিহাস গ্রন্থখানি দ্বারা মুসলিম পাঠকগণ কিভাবে উপকৃত হবেন। এবং কোন কোন অংশ একটু মনোযোগ সহকারে অধ্যায়ন করতে হবে। এবং অনেক জরুরী ব্যাপারে পাঠক ধারণা অর্জন করতে পারবেন। যা পুস্তকটির উপসংহারে লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা রইল। আল্লাহ তাওফীক দাতা।


      "প্রথম অধ্যায়"

                    আরব দেশ

আরবের একটা মোটামুটি আলোচনা সর্বপ্রথম এজন্য অবশ্যক যে, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আরবে প্রসিদ্ধ মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এবং বিখ্যাত  নগরী মদিনাতে হিজরত করেন এবং তাই হয় শেষ পর্যন্ত। ইসলামী রাষ্ট্রের আদি রাজধানী। আরব সেই দেশ যার প্রায় সকল অধিবাসী প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সে আরব যেখানে সর্বপ্রথম ইসলামের বিজয় কেতন উড়ে ছিল। এই আরবের বাসাতেই পূর্ণাঙ্গ ওহী এবং সর্বশেষ আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হয়। যা দেশ জাতি ও ভাষা নির্বিশেষে সকলের কেয়ামত পর্যন্ত কালের জন্য পূর্ণাঙ্গ দিশারী। এই আরবের মাটি থেকে পৃথিবীর দেশ দিগন্ত ইসলামের আলো বিচ্ছিুরিত হয়েছে। এ দেশেই রয়েছে পবিত্র কাবা ঘর। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ থেকে প্রতিবছর মুসলমানরা যেখানে ছুটে আসে। দলে দলে আরাফাতের ময়দানে সকলে মিলে আল্লাহ তাআলার কাছে মোনাজাত করে। সেখানে রাজা প্রজা আমির ফকির সকলেরই একই পোশাক, একই অবস্থা,আসমান জমিনের স্রষ্টার মহিমা ও অধিপত্যই সকলের মন মগজকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই সে আরব যা গোটা বিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। এর গোটা বিশ্বের জন্য দিক দিশারী ও হেদায়াতের দীপ্ত শিখা প্রতিপন্ন হয়।

অবস্থান ও ভূপ্রকৃতিঃ

এশিয়ার মানচিত্রে দক্ষিণ দিকে ভারতবর্ষের পশ্চিম দিকে একটি বিশাল আয়তক্ষেত্রের মত উপদ্বীপ চোখে পড়ে। এরিনাম জাজিরাতুল আরব আরব উপদ্বীপ বা আরব দেশ। আরব দেশের আয়তন বার তের লক্ষ্য বর্গমাইল। যার মধ্যে 5 লাখ বর্গমাইল কেবল মরু অঞ্চল যেখানে জনবসতি নেই।

আবহাওয়া ও অধিবাসীঃ

আরব দেশে কোন প্রসিদ্ধ  বা উল্লেখযোগ্য কোন নদী নেই। প্রায় গোটা দেশটাই ঊষর মরু ও অনুর্বর ভূমি নিয়ে গঠিত। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ মানুষ বসবাস অনুপযোগী এবং জীবনযাপন দুরবস্থায় রেখেছে। সমস্ত জনপদ সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্থিত। কেবল নজদের বিশাল প্রদেশটি এর ব্যতিক্রম। নজদা হচ্ছে একটি মালভূমি, যাতে বিশাল আয়তন মরুভূমি সমূহ রয়েছে। যা সিরিয়ার বিশাল মরুভূমি সমূহ গিয়ে মিশেছে। আরব দেশের স্থানে স্থানে পর্বতমালা রয়েছে কিন্তু এর একটি তেও কোন তরুলতা নেই। রুদ্রের প্রখরতা খুব বেশি, এত প্রচণ্ড লু হাওয়া দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় যে। এ হাওয়া কে সাইমুম বা বিষাক্ত বায়ু বলা হয়ে থাকে। মানুষ তো মানুষ একটি উঠ ও এ হাওয়ার সম্মুখে তৃষ্টাতে পারেনা। লু হাওয়ার এক ঝটকাতে উট প্রাণ হারায়। উট হচ্ছে মরুভূমির জাহাজ  এর পিঠে চড়ে বড় বড় সফর করতে হয়। খেজুর ছাড়া অন্য কোন উল্লেখযোগ্য ফসল হয় না। সে দেশের অধিবাসীরা উটের দুধ ও খেজুর খেয়ে জীবন ধারণ করে। এজন্যই এ দেশটির বড় বড় শহরের সংখ্যা নগণ্য।


আরবে মুস্তাআরিবাঃ

বনু আদনান ও হযরত ইসমাইল আলাইহিস ওয়াসাল্লাম এর বংশধর এ নামে পরিচিত। এরা বাহির থেকে এসে আরবে বসতি স্থাপন করেন, এজন্যই এদেরকে আরবে মুস্তারিবা মিশ্র আরব নামে অভিহিত করা হয়। হযরত ইব্রাহিম আলাই সাল্লাম এর মাতৃভাষা ছিল আজমি তথা ফার্সি। তিনি যখন তার পুত্র ইসমাঈল আঃ কে তার মা হাজেরা সহ মক্কায় রেখে যান। তখন তিনি কাহতানি গোত্রের শাখা গোত্র জুরহাম এর নিকট থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা করেন। এরা তখন মক্কায় বসবাস করত। পরবর্তীকালে এই আরবি হয় ইসমাঈল বংশের ভাসা। হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর 15 বছর বয়স কালে তার মা হাজেরা ইন্তেকাল করেন। মায়ের মৃত্যুর পর হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম মক্কা থেকে সিরিয়ার দিকে চলে যেতে মনস্থ করেন। কিন্তু জুরহাম গোত্রের লোকজন পরামর্শক্রমে তাকে মক্কা থেকে চলে যেতে বিরত রাখেন এবং আমালিকা গোত্রের আমারা বিনতে সায়ীদ ইবনে উসামা ইবনে আকিল এর সাথে বিবাহ করিয়ে দেন। কিছুদিন পর সেখানে ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করলেন। এবং তার ইঙ্গিতে পুত্র ইসমাঈল তার উক্ত স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। তারপর তিনি জুরহাম গোত্রের সাইয়িদা বিনতে মাদাদ ইবনে আমর কে বিবাহ করেন। এ ঘটনার পর আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের ভিতের উপর খানা কাবা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এভাবে যে হযরত ইব্রাহিম আঃ গাঁথুনি দিচ্ছিলেন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সাল্লাম পাতার ও মসলাদি তাকে উঠিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন উভয় দোয়া করছিলেন ঃ হে আমাদের রব। আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন! নিঃসন্দেহে আপনি সবকিছু শুনেন, সবকিছু জানেন।

ফলে দেওয়াল কিছুটা উঁচু হল এবং পুনঃ নির্মাণ কাজ কিছুটা কষ্ট হয়ে উঠলো। তখন হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে লাগলেন। যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজ করছিলেন তাই মাকামে ইব্রাহীম নামে পরিচিত। খানা কাবা নির্মাণ সমাপ্ত প্রায়, তখন হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন একখণ্ড পাথর নিয়ে এসো, যাতে তা মাকামে রুকরণের উপর রেখে দিয়ে লোকজনের জন্য তা চিহ্নিত করে দিতে পারি। তখন হযরত ইসমাঈল আঃ হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনা অনুসারে। বূ-কুবায়স পাহাড় থেকে হাজরে আসওয়াদ উঠিয়ে নিয়ে আসেন। হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মাকামে রুকন এর উপর স্থাপন করে দিলেন। এটাই সেই বিখ্যাত হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর তাওয়াফের সময় যার চুমু খাওয়া হয়। কাবা নির্মাণের পর হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যে সমস্ত লোক ঈমান এনেছিল। তাদেরকে নিয়ে মিনা ও আরাফাতের মাকাম সমূহের দিকে যাত্রা করলেন। তারা কুরবানী করলেন এবং খানায়ে কাবা তাওয়াফ করলেন। হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাম দেশের দিকে চলে যান। এবং যতকাল জীবিত ছিলেন প্রতিবছর কাবা জিয়ারত ও হজের জন্য আসতেন। খানায়ে কা'বা পুনঃনির্মাণের পর হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ জীবন পর্যন্ত মক্কাতে বসবাস  করেন।

তাওরাত এর বিবরণ অনুযায়ী হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৩৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর কালে তার ১২ জন পুএ ছিলেন।এদের বংশ এতই বাড়ল যে মক্কায় আর তাদের যাগা হচ্ছিল না।তারা গোটা হিজাযে ছড়িয়ে পড়লেন।কা'বার রক্ষা করা  দায়িত্ব সর্বদা তাঁদের হাতে ছিল। হযরত ইসমাঈল আঃ এর পুত্র কীদারের বংশধরদের মধ্যে আদনান নামক এক ব্যক্তির জন্ম হয়। আদনানের পুত্রের নাম মাআদ তার পুত্রের নাম নাজার ছিল। নাজারের চার পুত্রের থেকেই আদনানী বংশের বিস্তার ঘটে। এজন্য আদনানী কাবিলাকে মাআদি এবং নাজারিও বলা হয়ে থাকে।

আদনানী গোত্র সমূহঃ-

আদনানী গোত্রসমূহের মধ্যে আয়াদ,রবীআ ও মুদার গোত্র সমূহ সামাধিক বিখ্যাত। এদের মধ্যেও সে স্বার্থ দুটি গোত্র বিখ্যাত ছিল বেশি। মানে মর্যাদা এরা ছিল পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। মুদারি গোত্র সমূহের অন্যতম গোত্র বনূ কিনানা গোত্রের ফিয়ার ইবনে মালিকের অপর নাম ছিল কুরায়শ। উক্ত কুরাইশের বংশ গনের মধ্যে অনেক কবিলা উদ্বুদ্ধ হয়। এদের মধ্যে বনী সাহম,বনী মাখযুম, বনী হুমাহ, বনী আবদে মানাফ ইত্যাদি। বনী আবদে মানাফ সমাধিক বিখ্যাত। আবদে মানাফ এর ছিল চার পুত্র আবদে শামস, নওফিল, মুত্তালিব, এবং হাশিম। হাশিম এর বংশধর এর মধ্যে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাশিমের এক পুত্রের নামছিল মুত্তালিব তার ছেলে আব্দুল্লাহ আর তার ছেলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম। বিশ্বের সমস্ত মুসলমান তাঁরই উম্মত এবং তিনি আখেরি জামানার নবী। আর এই কিতাবে তারাই উম্মতের বিবরণ দেয়ার প্রায়শ পেয়েছি।

আব্দুল মুত্তালিব নামকরণের কারনঃ

হাসিম মদিনার জনৈক সর্দারের কন্যাকে বিবাহ করেন। তার গর্ভে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয় নবজাতকের নাম রাখা হয় শায়বা। শৈশবেই তার পিতা হাশিমের মৃত্যু হলে হাশিমের সহোদর মুত্তালিব মক্কার শাসক হন। হাসিমের শিশুপুত্র শায়বা মদিনায় প্রতিপালিত হন। শায়বার যৌবনের পদার্পণের সংবাদ পেয়ে মুত্তালিব তার ভাতিজাকে নিয়ে আসার জন্য মদিনায় যান। তিনি যখন তার ভাতিজাকে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন,তখন মক্কার লোক ভাবলো এ যুবকটি বনী মুত্তালিবের গোলাম হবে। মুত্তালিব তাদের এ কথা শুনে জানিয়ে দিলেন এ হচ্ছে আমার ভাই হাশিমের ছেলে আমার ভাতিজা। কিন্তু লোকজন তাকে আব্দুল মুত্তালিব বা আব্দুল মুত্তালিবের গোলাম নামেই অবহিত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত শায়বা ইবনে হাসিম আব্দুল মুত্তালিব নামেই পরিচিত হয়ে যান। উন্নত চালচলনে মানে মর্যাদায় দানে বদান্যতায় আব্দুল মুত্তালিব নিজেকে তার পিতা হাশিমের সুযোগ্য পুত্ররূপে প্রতিষ্ঠা করেন। আব্দুল মুত্তালিবের সময় হাবশার সৈন্যরা আবরাহা নামক সেনাপতির নেতৃত্বদীন মক্কা আক্রমণ করে। এ বাহিনী ইতিহাসে আসহাবে ফিল নামে অভিহিত হয়। আল্লাহর গজব তথা আসমানী আজাবে এ বাহিনী ধ্বংস হয়।



বংশ গরিমাঃ

এমতা অবস্থায় আরবদের মধ্যে স্বভাবতই দুটি বস্তুর প্রাইস গঠে। দীর্ঘ অবসর ও রাতের উন্মুক্ত আকাশের নিচে কর্মহীন দীর্ঘ আকাশ তাদের মধ্যে কাব্য চর্চার উন্মেষ ঘটায়। দ্বিতীয়তঃ নিজের অধিকার রক্ষার অব্যাহত অনুশীলন, ও সহিঞ্চু তার অভ্যাস। তাদেরকে যুদ্ধবাজ  ও কথায় কথায় শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত করে তুলেছিল পারস্পারিক যুদ্ধ-বিগ্রহ কে। জিইয়ে রাখার জন্য তারা আত্মপ্রশংসা ও বংশ গৌরব প্রকাশের দিকেও ঝুঁকে পড়ে অহমিকা প্রকাশ ও নিজের মহত্ব প্রকাশের জন্য বিরক্ত বদান্যতা ছিল। দুটি আকর্ষণীয় ব্যাপার কাব্যিকতা তাদেরকে প্রেম নিবেদন ও সচ্ছল লোকদেরকে মদপানে উদ্বুদ্ধ করে। আর বীরত্ব ও  বদান্যতা তাদেরকে প্রথম শ্রেণীর অতিথি পরায়ণ এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তাদেরকে অভ্যস্ত করে। সকলকে শ্রদ্ধাভাজন করে তুলে জুয়া, তীরন্দাজ, কবিসভা, বংশ মর্যাদার, অহমিকা প্রকাশ, ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রবৃতী ছিল তাদের চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। মোটকথা আরবের নিসর্গ ও আবহাওয়া মনের অজান্তেই তাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত চরিত্র গড়ে তুলেছিল। আরবে বাইদার প্রতি হযরত হুদ আলাইহি সাল্লাম হযরত সালেহ আলাইহি সাল্লাম প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কিরাম প্রেরিত হন। এসব আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রতি আনুগত্য না করায় সেই পর্যায়ে জনগোষ্ঠী উজার ও ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাহতানি আরবদের প্রতিও কতিপয় হেদায়াত কারী প্রেরিত হন। কিন্তু আরব বাসিরা খুব কমই তাদের কথায় কর্ণপাত করেছে। ফলে পাপাচার, অবাধ্যতার জন্য  বারবার তাদের উপর ধ্বংস নেমে এসেছে। সে দেশের অধিবাসীদের পাপাচার ও বশ্যতাহিন প্রকৃতি তাদের কে আম্বিয়ায়ে কিরামের শিক্ষা থেকে অনুগৃহীত হতে দেয়নি। হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ও খুব কম ঈমান এনেছিল। তাদের বংশ নিয়ে অহমিকা এবং আত্মগৌরব এর অভ্যাস ধর্মের ব্যাপারে তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রশস্তির দিকে ঠেলে দিয়ে, শেষ পর্যন্ত তাদের নামের প্রতিমা পূজায় অভ্যস্ত করে তুলে। যখন কাহতানি কাবিলা সমূহের প্রতিপত্তি লোভ পাচ্ছিল। এবং বনী ইসমাইল বা আদনানিদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তখন খুযায়া গোত্রের মক্কা আক্রমণ এবং জুরহাম গোত্রের বিপর্যয় আদনানী গোত্র সমূহকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয়ের সন্ধানে ছড়িয়ে দিয়ে, হিজাজে বনী ইসরাইলীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত করে। ফলস্রুতিতে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ও প্রদেশ আদনানী ও কাহতানি কাবিলা সমূহকে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবতীর্ণ করে। এভাবে গোটা আরব উপদ্বীপে ছোট ছোট গোত্রীয় রাজ্য ছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য রাজ্য আর অবশিষ্ট থাকল না।


পোশাক পরিচ্ছদ  ও খাবার দাবারঃ

আরব দেশে রেশম বা তুলা কিছুই উৎপন্ন হয় না। যদিও বা কোন প্রদেশে উৎপন্ন হয় তাও পরিমাণে এত অল্প যে, দেশবাসী প্রয়োজন মেটাতে পারেনা। ইয়ামানে প্রাচীনকাল থেকেই বস্ত্র বয়ন হয়ে আসছে। সাধারণভাবে আরববাসীদের লেবাস-পোশাক অত্যন্ত সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর ছিল। মোটা কাপড়ের জামায় চর্মের তালি লাগিয়ে পড়া ছিল সাধারন ব্যাপার। কেউ কেউ চামড়ার ছোট ছোট টুকরা কে সুচের দ্বারা ঢেকে নিয়ে চাদর বানিয়ে নিত, এ চাদর নির্দ্বিধায় তারা চাদর ও বিছানা রূপে ব্যবহার করত। উট ও ভেড়ার রুম দিয়ে কাপড় হত ডিলেডালা লম্বা কুর্তা, ও লুঙ্গি এবং মাথায় রুমাল ও পাগরী ব্যবহারের প্রচলন ছিল। সুগন্ধির ব্যবহারের সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত ছিল। আরবের আহার্য ছিল অত্যান্ত সাদাসিদে নিরস বিসাদ খাদ্যে তারা তৃপ্ত ছিল। গোসত ছিল তাদের সবচাইতে প্রিয় দুধ, চিনা, খেজুর, পনির, যবের ছাতু, জাইতুন তেল, হারিরা, প্রভৃতি ব্যবহারে চালু ছিল। বিনা ছাকা আটার রুটি রান্না করে খেত। পানাহারের রীতি-নীতি ছিল একান্তই সাদাসিধে। পানাহার সংক্রান্ত নবী করিম সাঃ এর হাদিস সমুহ বিধি-নিষেধের পাঠে সে সম্পর্কে একটি ধারণা উপনীত হওয়া যায়। যাতে অনেক প্রকার অশিষ্ট আচরণ করা হয়েছে। তাতে ওদিকে আহার, নির্লজ্জতা, নোংরামি, এবং বাজে বকা থেকে বারণ করা হয়েছে।

শোক বিলাপঃ

যখন কোন ব্যক্তির মৃত্যু হতো তখন তারা নিকটাত্মীয়রা কপাল ঘর্ষণ করে।  এবং মাথার চুল ছিড়ে হায় হায় করে বিলাপ করত। মহিলারা চুলের বেণী খুলে মাথায় মাটি মেখে লাসের পিছুপিছু চলত। যেমনটি ভারতের হিন্দুরা তাদের মৃত জনকের শুকে চুলা, গুফ, মুন্ডন, করে শোক পালন করে থাকে। জাহিলিয়াতের যুগে আরবে  মহিলাদেরকে ভাড়া করে আনা হতো। তারা জুড়ে সুরে ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাপ করত। দাফন কাফন শেষ করে বিলাপকারী দেরকে উত্তমরুপে আপ্যায়িত করা হতো। ইসলাম এসে সেসব জাহিলিয়াতের প্রতা পদ্ধতির অবসান ঘটায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে মৃত্যুর তৃতীয় দিন, দশম দিন, 40 তম দিন, এবং বার্ষিক সুখ, উৎসব করার কুসংস্কার করার এখনো চালু রয়েছে। আরব জাহিলিয়াতের প্রতিচ্ছবি আজও আমরা আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আস্তাগফিরুল্লাহ।

কুসংস্কারঃ

জিন পরি দৈত্য-দানবে ও জাহিলিয়াতের আরবরা বিশ্বাস করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে পরীরা পুরুষ লোকের প্রেমে পড়ে এবং জ্বীনরা নারীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। জিনদেরকে তারা অদৃশ্য জীবন বলে বিশ্বাস করত। আবার সাথে সাথে এটাও বিশ্বাস করত যে অশরীরী আত্মার সাথে মানুষের জ্বর দেহের মিলনে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। বেড়ার নর শাবক হলে তারা তা দেবতার নামে বলি দিত। পক্ষান্তরে মাদি হলে তারা তা নিজের জন্য রেখে দিত। যদি বেড়ার দুটি শাবক নর ও মাদি একসাথে জন্ম গ্রহণ করত তবে এগুলো তারা কুরবানী দিত না। তারা এগুলোকে ওসিলা নামে অভিহিত করতো।


২টি মন্তব্য: