নবিজীর জীবন




মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশ পরিচয়। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বংশ সারা দুনিয়ার সব বংশাবলী থেকে অতি পবিত্র।এটি বাস্তব সত্য কথা যে, কেহ তা অমান্য করতে পারেনি। রুমের সামনে হযরত আবু সুফিয়ান রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কাফির অবস্থায় তা স্বীকার করেছিলেন, অথচ তিনি তখন চেয়েছিলেন যে যদি কোনো সুযোগ-সুবিধা হয়ে যায় তাহলে তিনি ইসলামের উপর দোষারোপ করবেন।

 সম্মানিত পিতার পক্ষ থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বংশধারা।

 মুহাম্মদ সাল্লাহু অালাহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব  ইবনে মুররা ইবনে কাআব ইবনে লুয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালেক ইবনে নাজ্জার ইবনে কেনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদ্রিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুজার ইবনে নিজার ইবনে মাআদ ইবনে আদনান।

সম্মানিত মাতার পক্ষ থেকে বংশ তালিকা নিম্নরূপঃ-

 মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালম ইবনে আমিনা বিনতে ওয়াহাব ইবনে আবদে মানাফ ইবনে জোহরা ইবনে কিলাব, ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে কিলাব ইবনে মুররা পর্যন্ত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতার বংশের সাথে মিলিত হয়ে যায়।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের পূর্বে প্রকাশিত বরকত সমূহ।

যেভাবে সূর্যোদয়ের পূর্বে সুবহে সাদিকের বিশ্বব্যাপী আলো ও প্রান্তর লালিমা পৃথিবিকে সূর্যোদয়ের সুসংবাদ দেয়। ঠিক সেভাবে নবুয়তের সূর্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদয় হবার সময় যখন ঘনিয়ে এলো। তখন পৃথিবীর চারপাশে এমন অনেক ঘটনা প্রকাশিত হল যা  মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন বার্তা বহন করছিল। তাই এ সকলকে ইরহাসাত বা বৃত্তি বলে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত মাতা বিবি আমিনা থেকে বর্ণিত আছে যে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার মাতার গর্ভে ছিলেন তখন স্বপ্ন যুগে তাকে সুসংবাদ দেওয়া হলো যে সন্তানটি তোমার গর্ভে রয়েছে। তিনি উম্মতের দল পতি তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হবেন তখন তুমি এই দোয়া করো। আমি তাকে এক আল্লাহর আশ্রয়ে অর্পণ করলাম। এবং তার নাম রেখো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম। এছাড়া আরো বহু ঘটনা হয়েছে এইসব পুস্তিকায় তা বর্ণনা করার সুযোগ নেই।

হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মোবারক আবির্ভাব।

অধিকাংশ আলেমগণের মতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর আবির্ভাব রবিউল আউয়াল মাসের সেই বছর হয়েছিল। যে বছর আসহাবে ফিল কাবাঘর আক্রমণ করেছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আবাবিল নামক নগণ্য পাখি দ্বারা পরাজিত করেছিল। পবিত্র কুরআনে সূরা ফীল এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটিও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর বরকত সমূহের সূচনাস্বরূপ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম সেই ঘরে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে হাজ্জাজের ভাই মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের হস্তগত হয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ঘটনাটি 571 খ্রিস্টাব্দে 20 এপ্রিল সংঘটিত হয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর জন্ম হযরত ঈসা আলাই সাল্লাম এর জন্মের 571 বৎসর পরে হয়েছিল। মোটকথা যে বছর আশহাবে ফিল কাবা আক্রমণ করে সে বছর রবিউল আউয়াল এর 12 তারিখ সোমবার। এই দিন দুনিয়ার জীবনে এক অসাধারণ দিবস। যে দিবসে পৃথিবী সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য রাত দিন পরিবর্তনের আসল লক্ষ্য।আদম আলাই সাল্লাম বনী আদমের গর্ব। হজরত নুহ আলাই সাল্লাম এর নৌকার হেফাজতের নির্বেদ। হযরত ইব্রাহিম আলাই সাল্লাম এর দোয়া। হযরত মুসা আলাই সাল্লাম ঈসা আলাই সাল্লাম এর ভবিষ্যৎ বাণী সমূহের সততা প্রমাণ কারি। অর্থাৎ আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম  এই ধরনীতে শুভাগমন করেন। এদিকে পৃথিবীতে নবুয়তের সূর্য প্রকাশিত হলো। আর অন্যদিকে পারস্য রাজ কিসরা র রাজ প্রসাদ এর 14 টি গম্বুজ পরে। এবং উপসাগর একেবারে শুকিয়ে যায়। পারস্যের অগ্নি মন্ডপের হাজার হাজার বছরের প্রচলিত অগ্নি নিভে যায়। যা কখনো নির্বাপিত হয় নাই। মূলত এটি ছিল অগ্নি পূজা ও যাবতীয় গোমরাহীর সমাপ্তি। এবং পারস্য ও রুম রাজ্জতের পতনের ইঙ্গিত। 

মহানবী সাঃ এর সম্মানিত পিতার ইন্তেকাল;

মহানবী সাঃ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো জন্মগ্রহণ করেন নি। তার সম্মানিত পিতা আব্দুল্লাহ কে তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব মদিনা থেকে খেজুর নিয়ে আসার হুকুম দেন। আব্দুল্লাহ তাকে গর্ভবস্থায় রেখে মদিনায় চলে যান। সর্বসম্মতিক্রমে সেখানেই তার ইন্তেকাল হয়। পিতার ছায়া জন্ম হবার পূর্বেই মাথার উপর থেকে উঠে যায়।

বাল্যকাল ও দুধ পান;

সর্বপ্রথম শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে তার সম্মানিত মাতা। এবং কিছুদিন পর আবু লাহাবের বাদী সুয়াইবা দুধ পান করান। ইহার পর হালিমা সাদিয়া এই খুদার দেয়া দৌলতের বাগি হন। আরবের মাঝে সাধারণত এরূপ নিয়ম ছিল। তারা তাদের নিজ সন্তান কে দুধ পান করার জন্য আশেপাশের গ্রামগুলোতে পাঠিয়ে দিত। যার দ্বারা শিশুদের শারীরিক সুস্থতা লাভ হত। এবং বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিখতে পারতো। এজন্য গ্রামের অনেক মহিলা শহরে শিশু সংগ্রহের জন্য আসত। 
হালিমা সাদিয়া রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন যে। আমি সাদ সম্প্রদায়ের মহিলাদের সঙ্গে দুগ্ধ শিশু আনার জন্য তায়িফ থেকে মক্কায় রওয়ানা হই। সেই বছর দেশে দুর্ভিক্ষ ছিল আমার কুলেও একটি বাচ্চা ছিল। কিন্তু আমার আমার স্তনে এই পরিমাণ দুধ ছিল না যা তার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। রাত্রি বরা সে খুদায় ছটফট করত এবং আমরা তার জন্য সারারাত জেগে কাটিয়ে দিতাম। আমাদের একটি উঠছিল কিন্তু তারও কোন দুধ ছিল না। মক্কা শহরে যে লম্বা কান বিশিষ্ট উটের উপর সয়ার হয়েছিলাম। সেটি এতই কমজোর ছিল যে সকলের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারত না। এ কারণে সঙ্গীগণ বিরক্ত বোধ করছিল পরিভ্রমণ সমাপ্ত হল। মক্কায় যখন পৌঁছলাম যে মহিলা গনি শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে দেখতো। সুনত যে তিনি এতিম তখন কেউ তাকে গ্রহণ করত না। এদিকে হালিমার ভাগ্য তারকা চমকাচ্ছে তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে যান। এবং তার সমস্ত কিছুর অভাব চলে যায়। এমন কি তার সঙ্গে যে উটনি নিয়ে এসেছিল সেও সুস্থ হয়ে যায়। এবং তাড়াতাড়ি সফর করতে পারেন। এবং তারা যখন তাদের বাড়িতে ফিরেন তখন সেই উঠনির দুধ তৃপ্তির সাথে সবাই পান করেন। হালিমা সাদিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'আলা বলেন। এটাই প্রথম রাত যাতে আমরা তৃপ্তির সাথে খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন আমরা বুঝি এই সন্তানটি অত্যান্ত মোবারক হবে। এমনিভাবে আমরা নবী সাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর বরকত সমূহ সব সময় দেখতে  সিলাম। এমনকি দুই বছর পূর্ণ হয়ে যায়।  আমি মহানবী সাঃ এর দুধ ছাড়িয়ে দিলাম।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর প্রথম বাক্য;

হযরত হালিমা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন যে।যে সময় আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর দুধ ছাড়ালাম। তখন তার জবান মোবারকের মধ্যে এই কয়টি বাক্য হয়েছিল। আল্লাহু আকবার কাবিরা আলহামদুলিল্লাহি হামদান কাশিড়া ওয়া সুবাহানাল্লাহি বুকরাতাও ওয়াসিলা। এবং এই কথাটি ছিল তার প্রথম বাক্য। এবং তার শারীরিক গঠন প্রণালী অন্য সব বাচ্চাদের থেকে উন্নত ছিল। দুই বছর বয়সেই তাকে অনেক বড় দেখা যাচ্ছিল।  এখন আমরা আমাদের নিয়ম অনুযায়ী তাকে তার মায়ের নিকট নিয়ে গেলাম। কিন্তু তার বরকত সমূহের কারণে তাকে ছেড়ে আসতে মন চায়নি। ঘটনাক্রমে সেই বছর মক্কায় কলেরার রোগ ছিল। আমরা মহামারীর ভান করে তাকে পুনরায় সাথে নিয়ে এলাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে রয়ে গেলেন। তিনি ঘরের বাইরে যেতেন এবং ছোট্ট ছেলেদেরকে খেলাধুলা করতে দেখতেন কিন্তু নিজে খেলাধুলা থেকে আলাদা থাকতেন। একদিন তিনি আমাকে বলেন আমার অন্য ভাই কে দেখতে পাই না তারা কোথায় থাকে। আমি বললাম সে বকরি চরাতে যায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন আমাকেও তার সাথে পাঠাবেন। এরপর তিনি তার দুধ বাই আব্দুল্লাহ এর সাথে বকরি চরাতেন। 

একবার তারা উভয়ে পশুদের মধ্যে ফিরে বেড়াচ্ছিলেন। এমনতো অবস্থায় আব্দুল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছল। এবং বলে তার পিতাকে আমার কুরাইশ বাইকে দুজন সাদা কাপড় ওয়ালা লোক এসে শুয়ে তার পেট ছিঁড়ে ফেলেছে। আমার শামী ও আমি উভয় বয়পেয়ে দৌড়ে যাই এবং গিয়ে দেখতে পেলাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বসে আছেন। এবং তার চেহারার রং বদলে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ছেলে তোমার কি হয়েছে। তিনি বলেন দুজন সাদা কাপড় পরিহিত লোক এসে আমাকে ধরে শুইয়ে দিল। এবং আমার পেট চিরে তার মধ্যে কিছু সন্ধান করে বের করলো। আমি জানিনা তাতে কি ছিল। আমরা মহানবী সাঃ কে ঘরে নিয়ে এলাম। এবং পরে এক গণকের কাছে নিয়ে গেলাম গনক তাকে দেখেই সত্বর নিজ জায়গা থেকে উঠে গেল। এবং তাকে অপন বুকে জড়িয়ে ধরলো এবং বলল চিৎকার করে। হে আরববাসী যে বিপদ তোমাদের উপর পৌঁছার কথা ছিল তা প্রতিহত করো যার পন্থা হলো এই যে তোমরা এই ছেলেটিকে হত্যা কর। এবং আমাকেও তার সাথে হত্যা করে ফেলো। যদি তোমরা তাকে হত্যা করে ছেড়ে দাও তাহলে মনে রেখো সে তোমাদের ধর্মকে মিটিয়ে দেবে। এবং এমন এক ধর্মের প্রতি তোমাদের দাওয়াত দিবে যার কথা তোমরা শুনো নাই। হালিমা গণকের কথা শুনে শিউরে উঠলেন। এবং তাকে এই হতভাগার হাত থেকে টেনে নিয়ে বললেন যে তুমি পাগল হয়ে গেছো। তোমার দেমাগ চিকিৎসা করা দরকার। হালিমা তাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় ঘটনাটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে তার সম্মানিত মাতার নিকট ফিরিয়ে দিতে আসক্ত করল। কেননা তিনি তার যথাযোগ্য হেফাজত করতে পারছিলেন না। মক্কায় পৌঁছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যখন তার সম্মানিত মাতার নিকট অর্পণ করলেন। তখন তিনি বললেন আগ্রহভরে নিয়ে গিয়ে এতো তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনার কারণ কি। অত্যাধিক পীড়াপিড়ির পর বিবি হালিমা সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে হল। তিনি সব কথা শুনে বলেন নিশ্চয়ই আমার ছেলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অতঃপর তিনি গর্ভবস্থায় আশ্চর্যজনক ঘটনা বলি শুনালেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত মাতার ইন্তেকাল;

যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর বয়স 4 বা 6 বছর। তখন মদীনা থেকে ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে তার সম্মানিতা মাতাও দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। বাল্যকাল বয়স 6 বছর পিতার ছায়া তো পূর্বেই উঠে গিয়েছিলো। মায়ের স্নেহের কুল আজ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এই এতিম শিশু টিজে রহমতের কোলে লালন-পালন হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তিনি তো এই সকল কারণসমূহের মুখাপেক্ষী নন। সবকিছু আল্লাহ ভাল জানেন।

আব্দুল মুত্তালিবের ইন্তিকালঃ

পিতা-মাতার ইন্তেকালের পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার দাদা আবদুল মুত্তালিব এর কাছে বড় হচ্ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা দেখতে চেয়েছিলাম যে এই নবজাতক শিশু শুধু রহমতের কুলে লালিত-পালিত হবে। সমস্ত কার্যকারণের কারক যিনি আল্লাহ তিনি স্বয়ং লালন-পালনের জিম্মাদার হলেন। যখন তার বয়স 8 বছর 2 মাস 10 দিন হল। আব্দুল মুত্তালিব ও পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। এরপর তার চাচা তার অভিভাবক হন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাম দেশ ভ্রমণঃ

তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন চাচা আবু তালিবের কাছে থাকেন। এমনকি তার বয়স 12 বছর 2 মাস 10 দিন হল। তখন আবু তালিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে শাম দেশে ভ্রমণ করার ইচ্ছা করলেন। এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সঙ্গে নিয়ে শাম দেশের দিকে যাত্রা করলেন। এবং  পথিমধ্যে তাইমা নামক স্থানে যাত্রা বিরত করলেন।

তার সম্পর্কে এক ইহুদী পন্ডিতের ভবিষ্যৎবাণীঃ

তিনি তাই মা নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। ঘটনাক্রমে ইহুদি এক বড় পন্ডিত যাকে বুহাইরা রাহেব বলা হত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নিকট দিয়ে ভ্রমণকালে তাকে দেখে আবু তালিবকে সম্ভোধন করে বলল। আপনি কি তার প্রতি দয়া পোষণ করেন। এবং তার হেফাযত কামনা করেন। আবু তালিব বলল নিশ্চয়। একথা শুনে বুহায়রা রাহেব আল্লাহপাকের কসম খেয়ে বলল যে। আপনি যদি থাকে সাম দেসে নিয়ে যান তাহলে সেখানে ইহুদিরা মেরে ফেলবে। কেননা ইনি আল্লাহ পাকের নবী ইহুদি ধর্ম কে বিলুপ্ত করে দিবেন। আমি তার গুণাবলী সমূহ আসমানী কিতাবের মধ্যে দেখতে পেয়েছি। বুহায়রার কথা শুনে আবু তালিবের মনে ভীতি সৃষ্টি হল। এবং তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।

ব্যবসার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার সাম দেশে যাত্রাঃ

মক্কার মধ্যে সেই সময় একজন ধনী এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমতী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মহিলা ছিলেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। যেসকল গরীবদেরকে তিনি সাবধান বিশ্বস্ত মনে করতেন তাদেরকে তিনি নিজের মালামাল অর্পণ করে বলতেন  যে। এগুলো বিক্রয় করে আসো তোমাকে এই পরিমাণ দেয়া হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম যদিও তখনও নবুয়াত প্রাপ্ত হন নাই। কিন্তু ধর্মপরায়ণতা এবং বিশ্বস্থতা সারা মক্কাবাসী নিকট প্রসিদ্ধ ছিল। এবং প্রতিটি তার মনোনীত চরিত্রের প্রতি বিশ্বাস ছিল তিনি আলামিন নামে পরিচিত ছিলেন। এই কথাটি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট গোপন ছিলনা। এজন্যই তিনি চাইছিলেন যে তার ব্যবসার দায়িত্ব মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর উপর অর্পণ করে তার বিশ্বস্থতার দ্বারা উপকৃত হবেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নিকট বলে পাঠালেন যে। যদি আপনি আমার ব্যবসার মালামাল শ্যাম দেশে নিয়ে যান তাহলে আমি আমার একটি গুলাম আপনার খেদমতের জন্য সফরসঙ্গী করে দেব। এবং অন্যান্য লোকদেরকে যে পরিমাণ লাভের অংশ দেয়া হয় তার চেয়ে বেশি আপনাকে দেব। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সাহসী ও প্রশস্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে এই দীর্ঘ সফরের জন্য তৈরী হয়ে গেলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর গুলাম মাইসারা কে সঙ্গে নিয়ে। ১৬জিলহজ তারিকে সামের দিকে রওয়ানা হন। এবং অত্যান্ত বুদ্ধিমত্তার শহীত অধিক লাভে বিক্রয় করলেন। এবং শেখান থেকে অন্যান্য মালামাল ক্রয় করে ফিরে এলেন। মক্কায় পৌছে উনি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কেঅর্পণ করলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সেগুলো এখানে বিক্রয় করলেন। এবং দ্বিগুনের কাছাকাছি লাভ অর্জিত হল। শ্যাম দেশের পথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যখন এক স্থানে যাত্রা বিরত করলেন। তখন নাস্তুুরা নাম এক পন্ডিত নবীকে দেখতে পেলেন। এবং আখেরি জামানার নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর সমস্ত আলামত সমূহ যাবুর কিতাব সমূহে বর্ণিত হয়েছে। তা তার মধ্যে দেখে চিনে ফেলেন। রাহেব মাইসারা কে চিনতেন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার সাথের লোকটি কে মাইসারা উত্তরে বলল তিনি মক্কার অধিবাসী কুরাইশ বংশের একজন ভদ্র যুবক। নাছতুরা বললেন সময়ে এই যুবক নবী হবেন।

হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সহীত নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহঃ

হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভদ্রতা ও আশ্চর্যজনক জ্ঞান-গরিমা ও চরিত্র মাধুর্য দেখে। মহানবী সাঃ এর প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা ও খালিস বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল। যার ফলে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইচ্ছা পোষণ করলেন। যদি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মতি পোষণ করেন। তাহলে তিনি তার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হবেন। যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর বয়স 21 বছর হলো তখন হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর সাথে মহানবী সাঃ এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। তখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর বয়স ছিল 40 বছর। বিবাহে আবু তালেব ও বনু হাশেম এবং মুজার গোত্রের সমস্ত সরদার গান সমবেত হন। এবং আবু তালিব বিবাহের খুতবা পাঠ করেন। বিবাহে আবু তালিব যে খুতবা পাঠ করেন তার অর্থ এরূপঃ ইনি মুহাম্মদ সাঃ ইবনে আব্দুল্লাহ। সম্পদের দিক দিয়ে কম হলেও। মর্যাদাসম্পন্ন চরিত্র এবং সার্বিক পরিপূর্ণতার দরুন যে লোককে মোকাবেলায় রাখা হবে তিনি তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবেন। কেননা ধন-সম্পদ এক পতনশীল ছায়া। এবং প্রত্যাবর্তনশীল বস্তু বিশেষ। আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আতীয়তা সম্পর্কে সংবাদ আপনাদের সকলের জানা আছে। তিনি খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। তার সম্পূর্ণ মহর মুয়াজ্জাল নগদ হোক বা বাকি হোক তা আমার সম্পদ হতে দিবেন। আল্লাহর কসম তারপর তিনি অত্যন্ত সম্মান প্রতিপত্তির অধিকারী হবেন। আবু তালিবের এই বক্তব্য মহানবী সাঃ এর শানে তখন ছিল যখন তার বয়স 21 বছর। তখনো তাকে নবুওয়াত দেওয়া হয় নাই। মোটকথা হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর সাথে মহানবী সাঃ এর বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। তিনি দীর্ঘ 24 বছর নবীজির খেদমতে ছিলেন। কিছু কাল ওহি নাযিল হওয়ার পূর্বে। আর কিছু ওহী নাযিল হওয়ার পরে।



হযরত খাদিজার গর্ভ থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সন্তানঃ

হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর গর্ভ থেকে মহানবী সাঃ এর দুই ছেলে এবং জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্যবান ছেলেদের নাম কাসেম ও তাহের। মেয়ে চারজনের নাম হযরত ফাতিমা, হযরত জয়নাব, হযরত রুকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু আনহু। এরা সবাই হযরত খাদিজা রাঃ এর গর্ভজাত ছিলেন। অবশ্য ইব্রাহিম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর এইছেলে। মারিয়া কিবতিয়া এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার এই তিন ছেলে বাল্যকাল অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।


মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্যাগণঃ

হযরত ফাতেমা" রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মেয়ে গনের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন যে। ফাতিমা জান্নাতি মহিলাগণের সরদার। তার বিবাহ 15 বৎসর সাড়ে পাঁচ মাস বয়সে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সাথে সম্পন্ন হয়। বিবাহে ৪৮০ দিরহাম মোহরানা ধার্য হয়েছিল যা প্রায় একশত পঞ্চাশ বরি রুপা মুদ্রা ছিল। এই সাইয়্যিদাতুন নিছার জেহেয ছিল একটি চাদর, খেজুর গাছের ছালে বড়া একটি বালিশ, একটি চামড়ার গদি, একটি দড়ির খাট, একটি মশক, এবং একটি আটা পিসার চাক্কি, চাক্কি পেসন সহ সব কাজ নিজ হাতে করতেন।

হযরত জয়নাব" রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর বিবাহ আব্দুল্লাহ ইবনে রবির সাথে হয়েছিল। তাদের একটি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে অল্প বয়সে ইন্তেকাল করেন। এবং একটি কন্যা সন্তান ছিল যার নাম  উমামা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ফাতিমা রাঃ ইন্তেকালের পর তাঁকে বিবাহ করেন।

হযরত রুকাইয়া" হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর সহিত বিবাহ হয়। এবং হাবাসায় হিজরতের সময় তারি সাথে চলে যান। হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় নিঃসন্তান অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।

হযরত উম্মে কুলসুম" হিজরতের তৃতীয় সনে হযরত রুকাইয়া ইন্তেকালের পর। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম উম্মে কুলসুম এর সাথে উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে বিবাহ দেন। এ কারণে তার উপাধি ছিল জিন্নুরাইন অর্থাৎ দুই নূরের অধিকারী। তিনি নবীজির দুই মেয়েকে বিবাহ করেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুত্র সন্তান বাল্যকালে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে আল্লাহ তাআলার বিরাট হিকমত নিহিত রয়েছে। কন্যাগণ এর মধ্যে শুধু ফাতেমা রাঃ আনহু এর সন্তানগণ অবশিষ্ট ছিলেন। অন্যান্য কন্যাগণ এর মধ্যে কারো সন্তান হয় নাই। আবার কারো সন্তান হলে বেশি দিন জীবিত থাকেন নাই।

অন্যান্য স্বচ্চরিত্রা বিবিগনঃ

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১/হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর জীবদ্দশায় অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করেন নাই। হিজরতের তিন বৎসর পূর্বে যখন খাদিজার ইন্তেকাল করেন। এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু এর বয়স 49 বছর পৌঁছিল। তখন আরো কয়েকজন সচ্চরিত্রা মহিলার সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। যাদের পবিত্র নাম নিম্নে বর্ণিত হলোঃ-

২/ হযরত সাওদা বিনতে জামআ রাদিয়াল্লাহু।

৩/ হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

৪/ হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

৫/ হযরত জয়নাব বিনতে খুযাইমা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

৬/ হযরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

৭/ হযরত জয়নাব বিনতে জাহাশ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু।

৮/ হযরত জুয়াইরিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

৯/ হযরত উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

১০/ হযরত সাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

১১/ হযরত মাইমুনা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।

তারা মোট 11 জন ছিলেন যাদের মধ্যে দুইজন মহানবী সাঃ এর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। এবং বাকি 9 জন নবীজির ইন্তেকালের  সময় জীবিত ছিলেন।তা উম্মতের ঐক্যমতে শুধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ছিল। উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য চার জনের বেশি স্ত্রী একই সময় বিবাহ করা বৈধ নয়।


 নবীজী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রীগণের আলোচনাঃ

১/উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর অধ্যায়,

আমরা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর কিছুটা আলোচনা পূর্বে করেছিলাম। এখন ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত করব। দ্বিপ্রহর মক্কা নগরীর একটি লুক পরনে বেশভূষা অদ্ভুত ধরনের। লম্বা আলখাল্লা সেটাও বেশ পুরনো। মাতায় একটা সাদা রুমাল জড়ানো। লোকটি বয়স্ক চেহারায় রাজ্যের বলিরেখার ছাপ। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় তার চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকমের চকচক করছে। বৃদ্ধ লোকটি লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটছেন। যদিও তাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে তিনি লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেন। লোকটি সম্ভবত ইহুদী। ধর্মপ্রাণ বয়স্ক ইহুদিরা এ ধরনের লাঠি হাতে চলাফেরা করেন। লাঠি তাদের ধর্মের অন্যতম নিদর্শন। লোকটি হাঁটছেন এদিক সেদিক তাকাচ্ছে না। তার বেশভূষা আর চালচলন দেখে বুঝা যাচ্ছে তিনি কোন ব্যবসায়ী নন। তাছাড়া এখন হজের মৌসুম নয়। মক্কায় এখন ছোটখাটো একটা অর্চনার সময়। অর্চনা শুধু নারীদের জন্য বিশেষ, এর সময় নারীরা তাওয়াফ করে কাবা ঘর। মক্কায় একদল নারী তাওয়াফ করছে। কাবাঘরে তাদের মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক নারীরা যেমন রয়েছে তরুণীরা তেমন রয়েছে। কাবা ঘরের স্থাপিত লাত, উজ্জা, হুবল, ইত্যাদি নানা রকমের দেবতার নামে তারা তাদের সমর্পিত হৃদয়ের ভালোবাসা জানাচ্ছে। তাদের মুখে গীত চোখে অশ্রুজল হৃদয় বিগলিত।

টিক সময় বৃদ্ধ লোকটি এলেন কাবা চত্বরে। কাবার চারপাশে তাওয়াফ রত নারীদের দেখে তার চোখ দুটিতে কি যেন এক চমক খেয়ে গেল। চত্বরের পাশে একটি উঁচু স্থানে দাড়ালেন এবং নারীদের কে সম্বোধন করে বললেন। হে নারীগন, তখন নারীরা অবাক হয়ে তাকাল বৃদ্ধ লোকটির দিকে। কারণ তাওয়াফের সময় সাধারণত এভাবে কেউ কাউকে আহবান করে না। তারা তাওয়াফ থামিয়ে বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকালো। কে এই লোক তাকে তো মক্কার লোক মনে হচ্ছে না। কেউ তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। নারীদেরকে সচকিত হতে দেখে বৃদ্ধ লোকটি বলল। আমি তোমাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছি শুনে রাখ নিঃসন্দেহে তোমাদের এ মক্কা নগরীতে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তার নাম হবে আহমদ তোমাদের মধ্যে যার সুভাগ্য হয় দ্বিধাহীন চিত্তে সেই নবীর স্ত্রী হয়ে যেও।

মক্কার নারীদলটি বিরক্ত হল বৃদ্ধের এমন কথায়। বলা নেই কওয়া নেই কোথায় থেকে এক বুড়ো এসে বলে গেল মক্কা নগরীতে নবী আসবেন। মক্কার নারীরা যেন তার স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য লাভের ধন্য হয়। কি এসব আবোল তাবোল কথা বলছে। আমরা তো আমাদের দেবতা কে ভালবাসি। আমরা কেন আমাদের দেবতাদের ছেড়ে কোন নবীর কথা শুনতে যাব। এই বলে তারা বৃদ্ধ লোকটির উপর কেউ পাথর, কেউ জুতো দিয়ে ছুড়ে মারল বৃদ্ধার দিকে। নারীদের এই অবস্থা দেখে বৃদ্ধ লোকটি সেখানে আর বেশিক্ষণ রইলেন না। কোনরকম দৌড়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে চলে গেলেন।

তামাশার এই গুর আঁধারে কোন নারী কী কামনা করে এক বিন্দু ঐশ্বরিক আলোকবিবার। তাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত কোন এক নবীর আগমনে অপেক্ষমান।

কাবার পাশে একটি বাড়ির ছায়ায় বসে ছিলেন এক নারী। দীর্ঘকায় উজ্জ্বল মুখ, রক্তিম অধর, চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ, বয়স ত্রিশের কোঠায়, যৌবনের লালিমা এখনো ঢাকা পড়েনি। তার বয়স ও অভিজাত্যের আড়ালে এ নারীর নাম খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ।

মক্কার লোকেরা তাকে তাহিরা বলে ডাকত। কারণ তার চরিত্রে যেমন নিষ্কলুষ তেমনি পবিত্র জীবন। তিনি কখনো মূর্তি পূজা করেন না। কাবা তাওয়াফে কখনো এলে কেবল অদৃশ্য একক সত্তার আরাধনা করেন। আজও তিনি অন্য নারীদের সঙ্গে তাতে অংশ নেননি। তার কয়েকজন বান্ধবী সেখানে তাওয়াফ করছে তিনি তাদের অপেক্ষায় বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় শুনলেন বৃদ্ধের আগমনী আহ্বান। সোনার সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরমহলে শুরু হলো অভাবনীয় ভাঙচুর। একজন নবী আসবেন এ মক্কা নগরীতে তার বধু হবেন এ নগরীর কোন এক নারী। কে হবেন সেই সৌভাগ্যবতী নারী। অন্যান্য নারীরা হাসাহাসি করলেও তিনি হাসতে পারলেন না। তার ভেতরে তৈরি হতে লাগল এক তীব্র হাহাকার। যে হাহাকার আজ থেকে বহু দিন আগে তৈরি হয়েছিল তার চাচাতো বোন উম্মে কিতালের হৃদয়ে। একজন নবীর আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন তিনিও। কিন্তু তার ভাগ্যের সহায় হয়নি। এবার তার ভাগ্যে কি হবে সেই নবীর চরণতলে এক বিন্দু ভালোবাসার নজরানা পেশ করার। খাদিজার হৃদয় ব্যথায় কুঁকড়ে গেল নবীর সহধর্মী না হোক।অন্তত জীবদ্দশায় কি একবার দেখতে পারবেন সেই চন্দ্র মহিম মুখ। খাদিজা আর কিছু ভাবতে পারলেন না। কাবার পাশ থেকে উঠে গেলেন একা একা হাটতে লাগলেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেল এর বাড়ির দিকে। ওয়ারাকা দহলিজে বসে নিবিষ্ট মনে কিছু জব করছিলেন। তিনি মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নন। যদিও বিশ্বাসের দিক থেকে তিনি খ্রিস্টান ইহুদি দর্মেও তিনি খুব একটা আস্থা রাখেন না। তিনি ভাল করেই জানেন এই দুই ধর্ম আর তাদের উৎসমূলে সঠিকভাবে নেই। কালের গর্ভে যেমন বিলীন হয়ে গেছে নবী মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনীত শরীয়তের অনেক পয়গাম। তেমনি সময়ের সাথে সাথে মানুষ তাদের মনগড়া শরীয়ত বানিয়ে আসন গেড়েছে। তবে তিনি তাওরাত ও ইঞ্জিল এর পাটক। আরবের অল্প কয়েকজন ধর্মীয় পন্ডিতের তিনি একজন। অনেক কাজে ওয়ারাকা সাহায্য করে থাকেন খাদিজাকে। এমনিতে খাদিজা অনেক বড় ব্যবসায়ী তার সম্পদ প্রচুর কিন্তু তিনি শুধু একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন না। সমাজের অনেক উন্নত মূলক কাজের তিনিও উধার। বিশেষত আরবে কন্যাদের অবজ্ঞা করার বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।অনেক আরব নিজের কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ শুনলে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করে ফেলত। লোকেরা মনে করত কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাদের গোত্রীয় অসম্মান হবে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এমন নির্দয় পিতার ঘরে কন্যা শিশুর জন্মের সংবাদ পেলে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং তাদের প্রতি পালনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। খাদিজা বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকতেই সচকিত হয়ে উঠলো ওয়ারাকা।তিনি বলে উঠলেন কে খাদিজা। তিনি পায়ের কাছে এসে বসলেন। মাথা নেড়ে জবাব দিলেন হ্যা  আমি। ওয়ারাকা মনোযোগী হলেন, তিনি জানেন খাদিজা কখনো অনর্থক কথা বলার জন্য কখনো আসেনা। খাদিজা বলতে লাগলেন কিছুক্ষণ আগে মক্কার কয়েকজন নারী যখন কাবা তাওয়াফ করছিল। তখন কোত্থেকে যেন এক বৃদ্ধ লোক এলেন কাবার পাশে। ইহুদি হবে পোশাক-আশাকে তাই মনে হল। তারপর তিনি ওই বৃদ্ধ লোকটির কান্ড গুলো বললেন। ওয়ারাকা বৃদ্ধ লোকটির খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন খাদিজাকে। সবকিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিচু করে নীরব রইলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন নবী আসবেন খুব শিগগির নবী আসবেন। নবী আগমনের সকল নিদর্শন প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। চারো দিকে গুড় তামাশা, মানুষের মাঝে মানুষসত্য বলতে কিছু নেই। আর জুলুম পাপাচার এসে গেছে ধরণীতল। অন্ধকারের কালিমা ভেদ করে নতুন আলোক বর্তিকা হতে একজন নবীর আগমন হবে। তিনি আসবেন তিনি আরবে আসবেন। তার নাম হবে আহমদ আহমদ নামেই তিনি পরিচিত থাকবেন।

আজকাল খাদিজার ঘুম খুব কম হয়। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। ঘুমালে কি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বাস্তবতা তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। স্বপ্নের মাঝে প্রায়ই দেখান আকাশ থেকে নেমে আসছে রূপালী ধবধবে আলোক বিচ্ছুরণ। সে আলো ঘরের ছাদ বেদ করে আশ্রয় নিচ্ছে তার সমগ্র সত্তায়। তার কুল জুড়ে ছোটাছুটি করছে আলো। ঝলমল করতে করতে সে আলো মিনারের মতো অবয়ব নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে। ঘর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো মক্কায় জাজিরাতুল আরব পর্যন্ত। আরব থেকে পুরো কায়েনাত আলোকিত হয়ে উঠছে। এরপর ঘুম ভেঙ্গে যায়। এরপর এদিক সেদিক করে আবার একিই স্বপ্ন দেখেন। তিনি বুঝতে পারেন না কেন বারবার একই স্বপ্ন দেখেন। অনেক সময় একা একা ভেবে হাঁপিয়ে যান। নিজের অতীত জীবন নিয়ে ভাবতে থাকেন বয়স 30  পেরিয়েছে। এরই মধ্যে দুবার বিদগ্ধ স্বাদ পেয়েছেন বিধবার। জীবন নিয়ে এক ধরনের বিতৃষ্ণানা হয়ে গেছেন। বিয়ে এর বিষয়টির উপর একটা বিরাগ হয়ে এসেছে। অনেকেই তাকে এখন বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তুু তিনি সবাইকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন এবং বলছেন দয়া করে আমাকে মাফ করবেন।



মক্কার সবচেয়ে বিত্তশালী নারী। তার সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে লোকজন তাকে 'কুরাইশ রাজকুমারি' নামে ডাকে। ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর সুনাম শুধু মক্কায় নয়। সুদূর রুম, পারস্য, ইয়ামেন,হীরা, দামেস্ক, পর্যন্ত। গৃষ্ম কালীন ব্যবসা মৌসুমে পুরু মক্কার ব্যবসায়ীদের যে পণ্য সামগ্রী রপ্তানি হয়। খাদিজার একার পণ্য রপ্তানি হয় তাদের সমুদয় পণ্যের চেয়ে অধিক। আবার শীতকালীন মৌসুমে যখন তার পণ্য ইয়ামেন অভিমুখে রওয়ানা হয়। তখন তার উটের কাফেলার ভরে যায় মক্কার প্রান্তর। সুতরাং এমন ধনী নারীকে বিয়ে করতে উৎসাহী হওয়ার কারন সবার কাছে স্পষ্ট।

কিন্তু খাদিজার নতুন করে বিয়ে শাদী কিংবা ঘর-সংসার করতে তেমন আগ্রহ নেই। কেননা তার স্বপ্নে যে আজকাল ধরা দিচ্ছে ওর ধনুকের আলোক বিভা। কেমন করে তিনি আগ্রয্য হবেনে আলোর ঝর্ণাধারা স্বর্গীয় সম্মোহন। চাচাতো ভাই ওরাকার প্রজ্ঞা অনুধাবন তার মন ভরে যেন উদগত করছিল। আকাঙ্ক্ষার নতুন চারা গাছ মনে দ্বিধা সত্যিই কি তিনি আমার হবেন। যিনি আসবেন মানবতাকে নতুন এক আলোর বিবাসিত করবেন। যিনি আসবেন সকল তামাশার জীর্ণতাকে বিদীর্ণ করে। তবে কেন আমি প্রতিদিন এমন স্বপ্ন দেখি। নিশ্চয়ই এর কোন ঐশ্বরিক ইশারা রয়েছে এই ভেবে খাদিজা আপ্লুত হন।

আল্লাহ তা'আলা খাদিজাকে অঘোষিত নবীর জন্য প্রস্তুত করছিলেন। তার অন্তঃকরণ কে তৈরি করেছিলেন রাসুলের ভালোবাসার জন্য। তার হৃদয়ের সিংহাসন সজ্জিত করছিলেন নবী মুহাম্মদ এর জন্য।

স্বপ্নের অলৌকিক আলোর বিচ্ছুরণ এর কথা জানানোর জন্য খাদিজা এলেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেলে এর কাছে। তার কাছে খুলে বলেন প্রতিটি স্বপ্নের কথা। শুনে ওরাকার চোখের কোনে এক বিন্দু জল টলমল করে উঠলো। খাদিজার কথা শেষ হতেই তিনি দুই হাত উত্তোলন করে উল্লাসিত ধনী করে বলে উঠলেন। সুসংবাদ মারহাবা হে আমার বোন তোমার জন্য এক অবশ্যম্ভাবী সুসংবাদ। খাদিজা এ স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য এক ঐশী উপহার। আলোর অবয়ব খুব শিগগির আল্লাহ তোমাকে দান করবেন। সবকিছু আল্লাহ ভাল জানেন। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো এর আলো কেবল একজন নবীর হতে পারে। এ আলোর বিচ্ছুরণ একজন নবীর আগমন কে ইশারা করে। 

ওরাকার উল্লাসিত ধ্বনি থামতে খাদিজা খানিকটা কেপে উঠলেন। যতটা খুশি হলেন তার চেয়ে বেশি বিহ্বল হলেন। তিনি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কোন কথা বললেন না। খাদিজাকে চুপ করে থাকতে দেখে ওয়ারাকা উচ্ছসিত কন্ঠে এবার বলে উঠলেন। আমার কথা বিশ্বাস করো 'খাদিজা' শেষ নবী ইতিমধ্যে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। আর তুমি তার স্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। এমনকি তোমার জীবদ্দশাতেই তিনি নবুওয়াত প্রাপ্ত হবেন। আন্তঃধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তুমি হবে তার প্রথম অনুসারী। আমি যদি আরো স্পষ্ট করে বলতে চাই তিনি হবেনে কুরাইশ বংশের হাশেম গোত্রের একজন পুরুষ।

খাদিজা আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না। তার হাত পা কাপছে মনে হচ্ছে তিনি এখনই পড়ে যাবে। হৃদয়ের সকল তন্ত্রীতে যেন বয়ে যাচ্ছে অপার্থিব কোন সুনিত ফুয়ারা। খাদিজা এত আনন্দ সহ্য করতে পারছেন না তিনি তাড়াতাড়ি নিজের বাড়ি চলে গেলেন। এতদিন তিনি কেবল স্বপ্ন আর কল্পনায় ছিলেন এখন তিনি যে বাস্তবতার খুব কাছে। কিন্তু আবার নিজের দিকে তাকালে অনিচ্ছুক ভয় এসে জাপ্টে ধরে থাকে। তার বয়স বয়স চল্লিশের কাছাকাছি যৌবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ভাগ্য কি তার প্রতি সুপ্রসন্ন হবে? খাদিজার মাথায় চিন্তা বইতে লাগলো এতদিন স্বপ্নপুরুষ কল্পনায় ছিল সেইত ভালো ছিল। কিন্তু এখন যে তার আগমন অত্যাসন্ন। তিনি প্রভুর দরবারে হাত পাতালেন 'হে আল্লাহ' কোথায় গেলে পাবো তাকে। খাদিজা অপেক্ষা করছিলেন পুরো পৃথিবী অপেক্ষা করছে।

মক্কায় এ বছর বেশ খর পড়েছে। আশেপাশের চরণভূমি গুলো বিরান প্রায়।গরু ও মেষ ছড়ানোর মতো পর্যাপ্ত গাস পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। অগত্যা মক্কার সামর্থ্যবান সবাই গ্রীস্মের এ মৌসুমে সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবসার জন্য দামেশকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সেখানে গেলে সবারই কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কুরাইশ নেতা আবু তালেব বংশ মর্যাদায় যথেষ্ট প্রভাবশালী হলেও তার সাংসারিক অবস্থা সচ্ছল নয়। আর তার সন্তানদের কেউ কখনো এতটা শক্ত সামর্থ্যবান হয়ে উঠেনি। যে তাদের ব্যবসা ও মেষ ছড়ানোর কাজে লাগাবেন। তার পরিবারে প্রতিপালিত ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ তার পরিবারের রোজগারের অনেকখানি বহন করেন। তার সঙ্গে ব্যবসার কাজে দামেস্কে জান বা মেষপাল নিয়ে চরণ ভূমিতে জান।এটা তার জন্য অনেক সন্তোষের। আবু তালিবের বয়স হয়েছে বয়সের ভারে এখন বড় একটা এদিকসেদিক যেতে পারেন না। কিন্তু এবছর ব্যবসার জন্য দামেশকে না গেলেই নয়। সংসারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, আবার নিজের তেমন কোন অর্থ সম্পদ নেই যা দ্বারা ভাতিজা মোহাম্মদ কে পুঁজি দিয়ে ব্যবসা পাঠাবেন। কয়েকদিন দুশ্চিন্তার দোলাচলে রইলেন তিনি।

ওদিকে খাদিজার ব্যবসায়ীক অর্থ-সম্পদ বা কাজের লোকজনের অভাব নেই। নিজস্ব পণ্য ছাড়াও তিনি লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে অন্য ব্যবসায়ীদের ব্যবসার জন্য মুলধন প্রদান করে থাকেন। তার ব্যবসার শেষে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত মুনাফা খাদিজা কে বুঝিয়ে দেন। এসব কাজের নিয়োগপ্রাপ্ত লোক আছে। তাছাড়া তার ভাগ্নে হাকিম ইবনে হিজামা ব্যবসার অনেককিছু দেখাশুনা করেন। কিন্তু তবু এবার কার মওসুমে ব্যবসা পরিচালনার জন্য নতুন একজন লোক চেয়ে মক্কায় ঘোষণা দিলেন। যাকে তিনি ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে দামেস্কে পাঠাবেন। খাদিজার নতুন লোকের প্রয়োজন ছিলনা। আর প্রয়োজন হলেও সেটা ঘোষণা করে বলার দরকার ছিল না। তিনি ইচ্ছা করলে যেকোনো একজন ভালো ব্যবসায়ীকে ডেকে এ দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দিতে পারেন। শুধু তাই নয় তিনি তার ঘোষণার মধ্যে এক শর্ত জড়িয়ে দিলেন। আগ্রহী ব্যক্তিকে অবশ্যই বিশ্বস্ত এবং আমানতদার হতে হবে। তার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তার নিয়োগের অন্যতম শর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। 

মূলত খাদিজা ব্যবসার জন্য লোক খুঁজছিলেন না। তিনি খুঁজছিলেন সত্তিকারের মানব কে। তিনি জানতেন তার চাচাতো ভাইয়ের কথামতো অনাগত নবী যদি সত্যি আরবে আগমন করে থাকেন। তবে তার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা এবং বিশ্বস্থতা হবে সবার চেয়ে নিখুঁত। যার চরিত্রে কখনো স্পর্শ করেনি সামান্য পঙ্কিলতা। কিন্তু এমন লোক তিনি কিভাবে খুজে বের করবেন। মক্কা ও এর আশেপাশের এলাকায় হাজারখানেক কুরাইশী লোকের বসবাস। তাদের মধ্যে থেকে কেবল চারিত্রিক গুন ধরে খুঁজতে গেলে সেটা অত্যন্ত কঠিনসাধ্য কাজ হয়ে যাবে। এ কারণে তিনি ব্যবসার কথা বলে নিজের কাংখিত ব্যক্তিকে খুজার পদ্ধতি অবলম্বন করলেন।

আবু তালেব লোকমুখে শুনতে পেলেন খাদিজার ঘোষণা। এমন দুর্দিনে তিনি কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলেন। খাদিজার শর্তগুলো তাকে আরো আগ্রহ করল। কেননা তিনি ভালো করেই জানেন বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতায় তার ভাতিজার তুলল নেই সারা আরবের। তাছাড়া  ব্যবসায়ী হিসেবেও তার ভাতিজা কম নয়। তিনি নিজে দুবার তাকে দামেস্কে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যবসার সঙ্গী করে। সে হিসাবে তার অভিজ্ঞতা কম নয়। খাদিজার এমন ঘোষণা শুনে তাই তিনি দেরি করলেন না। ভাতিজা মোহাম্মদকে জানালেন বিষয়টি। আবু তালিব মোহাম্মদ কে ডেকে বললেন, ভাতিজা তুমি তো জানোই আমি ভিত্তিহীন একজন মানুষ। এবছর দুর্ভিক্ষের ফলে দারুন অভাবে পড়েছি। আমরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবসা বা অন্য কোনো উপায়ে উপকরণে এ মুহূর্তে আমার হাতে নেই। আজ শুনলাম আমাদের গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফেলা শিগগির দামেস্কে যাচ্ছে। এ কাফেলায় খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ এর অনেক অনেক পণ্য যাবে। সে তার বাণিজ্য বহর পরিচালনার জন্য একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি তালাশ করছে। নানা কারণে যদিও আমি তোমাকে আমার চোখের আড়াল করতে চাই না।এবং সঙ্গত কারণেই ইহুদিদের থেকে আমি তোমার ক্ষতি সাধনের ভয় করি। কিন্তু বুঝতেই পারছ তাছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। যদি তুমি তার কাছে যাও তবে আমি নিশ্চিত যে সে তোমাকে তার ব্যবসার জন্য নির্বাচন করবে। তোমার সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক ব্যাপারে তার অবগতি থাকার কথা নয়। নবীজি তার চাচার কথা শুনে সম্মতি প্রকাশ করলেন। তিনি চাচাকে এ বিষয়ে কথা বলতে বললেন। কিন্তু আবু তালিবের যে বংশ মর্যাদা এবং জাত্যভিমান তাতে বাতিজার পক্ষে স্বপ্রণোদিত হয়ে খাদিজার কাছে গিয়ে কাজের ব্যাপারে আগ্রহ দেখানোটা ভালো দেখায় না। কিন্তু না গেলেও যে না হয়। একটা দুটানায় পড়ে গেলেন তিনি।

এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন আবু তালিবের বোন আতিকা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। ফুফু আতিকার বিয়ে হয়েছে খাদিজার ভাই এর সাথে।   ভাবি হিসেবে খাদিজার সঙ্গে আতিকার সম্পর্ক রয়েছে। মোহাম্মদের সম্মানের কথা ভেবে তিনি ও তার ভাই আবু তালিব কে নিষেধ করলেন তাকে খাদিজার কাছে পাঠানোর জন্য। বরং তিনি নিজে গিয়ে প্রথমে আলাপ করলেন। মোহাম্মদের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। আতিকা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব খাদিজা এর কাছে মোহাম্মদ এর ব্যাপারে বলার আগে বেশ কয়েকজন কুরাইশি ব্যক্তি খাদিজার কাছে এসেছে। এ কাজ নিয়োগ পাওয়ার জন্য। কিন্তু খাদিজা তাদের সবার জীবন বৃত্তান্ত গেটে দেখেছেন। কোনো না কোনো অসুবিধা আছে। কেউ হয়তো পরনারীতে আসক্ত, কেউ জুয়া, বা ইত্যাদি খারাপ কাজে আছে। প্রতিদিন এরকম লোকের সাক্ষাৎ পাচ্ছেন আর দু এক কথা বলে বিদায় দিচ্ছেন। ভাবি আতিকার কাছে মোহাম্মদের  কথা শুনে ভেতরে অন্যরকম এক কম্পন শুরু হয়ে গেল। মোহাম্মদ, আহমদ, আলামিন, এই কি সেই ব্যক্তি? ওরাকার ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী সেই নাম, সেই বংশ, সেই চারিত্রিক উৎকর্ষ, ভদ্রতার মানবতায় তুলনাহীন। যার সততা ও বিশ্বস্ততা পুরো মক্কায় ছড়িয়ে রয়েছে। এ মুহাম্মাদ কি সেই তিনি নন। আহা এতদিন কোথায় খুঁজেছি আমি তাকে। অধীর হয়ে তার অপেক্ষায় আছি। খাদিজা দেরি না করে খবর পাঠালেন আবু তালিবের কাছে।আবু তালিব মোহাম্মদ কে না পাটিয়ে নিজে এলেন। মোহাম্মদ কে পাঠানোর আগে কিছু বিষয়ে আলোচনা করে নেওয়া দরকার। তিনি খাদিজার কাছে এসে তার বাতিজার উত্তম গুণাবলী বর্ণনা করলেন। এটা করলেন যতটা না খাদিজাকে বুঝাতে তার চেয়ে নিজের হৃদয়ের দুশ্চিন্তা প্রশমন করতে। কেননা তিনি এর আগে মোহাম্মদকে নিয়ে যখন দামেস্কের সফর করেছিলেন। তখন এক ইহুদি পাদ্রীর মুখে মোহাম্মদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অস্বাভাবিক কিছু কথা শুনেছিলেন। যে কথাগুলো এখনো তার মনে পাথরের মত হয়ে আছে। তিনি তা কারো কাছে প্রকাশ করেননি। কেননা ইহুদিরা যদি মোহাম্মদের এমন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানতে পারে। তবে তাকে হত্যা করতে কসুর করবে না মোটেও। কারণ হিংসার বশবর্তী হয়ে তারা অনেক নবীকে হত্যা করেছে। নবী ঈসা কে হত্যা করতে চেয়েছিল তারা। এই ভয়ে ভাতিজাকে তিনি সবসময় নিজের কাছে আগলে রাখেন।


খাদিজার কাছে মোহাম্মদের ব্যাপারে বলার পর তিনি দাবি করলেন। অন্যদের আপনি আপনার ব্যবসা পরিচালনার জন্য যে পারিশ্রমিক প্রদান করেন মোহাম্মদকে তার দ্বিগুণ দিতে হবে। কেননা তার ব্যক্তিত্ব অন্য সবার চেয়ে আলাদা। ব্যবসায়ী হিসাবে তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ত তা অন্যদের থেকে তুলনাহীন। সুতরাং একটি উট নয় পারিশ্রমিক হিসাবে তাকে দুটি প্রদান করতে হবে।

খাদিজা আবু তালিবের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। তিনি কি সত্যিই আবু তালিবের কথা শুনছিলেন? তার শারীরিক অবয়ব উপবিষ্ট ছিল আবু তালিবের সামনে। কিন্তু সমগ্র আত্মা ভেসে বেড়াচ্ছিল অন্য কোথাও। তার চোখ খুলা কিন্তু তার চোখের তারায় ঝিকমিক করছিলো অন্য লোকের অপার্থীব ছায়াছবি।

খাদিজা আবু তালিবের কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। আবু তালিব যা দাবি করলেন তা বিনা বাক্যে মেনে নিলেন। যার পায়ের সামনে লুটিয়ে দিতে পারেন তার সবকিছু। সেখানে দুটি উঠত আর তার কাছে তুচ্ছ। তিনি আবু তালেবকে শুধু বলতে পারলেন হে আবু তালিব আপনি আপনার ভাতিজার জন্য যা দাবি করেছেন তা অসাধ্য নয়। তা সন্তুষ্ট জনক পারিশ্রমিক। আমি শপথ করে বলছি - আপনি যদি এর চেয়ে অধিক কিছু দাবি করতেন তবে আমি তা দিতেও প্রস্তুত।

যুবক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজার কাছে এলেন ব্যবসার যাবতীয় নির্দেশনা বুঝে নেওয়ার জন্য। খাদিজার নির্ণয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এ যুবকের দিকে। এর আগে যদিও দু-একবার তাদের দেখা হয়েছে। কিন্তু এবার কার সাক্ষাৎ একেবারেই অন্যরকম। বিশেষত খাদিজার কাছে তো চন্দ্র অভিযানের সমতুল্য। খাদিজার চোখজুড়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মানব সত্যিই কি? তিনি হৃদয় অলিন্দে এখনো কয়েক বিন্দু দোলাচল জমে আছে। খাদিজা তার বিশ্বস্ত ক্রীতদাস মায়সারা কে একান্তে ডাকলেন। প্রথমেই তাকে জানালেন এই বাণিজ্য সফরে মুহাম্মদের ভৃত্য হয়ে যেতে হবে। কিন্তু এটা তার মূল দায়িত্ব নয় তার কাজ হচ্ছে মোহাম্মদের ছায়াসঙ্গী হয়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করা। তার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, ব্যবসার আলোচনা, সব যেন তিনি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন। শুধু তাই নয় যাওয়া আসার প্রতিটি ঘটনা তাকে ভালো করে দেখতে হবে। মোহাম্মদের একটি কদমো যেন তার অগোচরে কোথাও না পড়ে। আর ফিরে এসে তাকে তা সব খুলে বলে।

নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কাফেলা রওয়ানা হল। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দিকে বানিজ্য কাফেলা পৌঁছে গেল। দামেস্কের বিরাট বাজারে রুম, পারস্য, আরব, আফ্রিকা, আর হিন্দুস্তান, বড় বড় ব্যবসায়ীরা নানারকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন তারা। ওদিকে ব্যবসায়ী আর বাজারকারীদের হাঁকডাক, মানুষের পদচারণায় মুখর। চারপাশে ঘোড়া, গাঁদা, উঠ, গুলজার করে রেখেছে পুরো দামেস্ক বাজার।

মোহাম্মদ তার বাণিজ্য বহর নিয়ে বাজারে নির্দিষ্ট জায়গায় তাঁবু গাড়লেন। পণ্য সাজিয়ে বসে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। মায়সারা চোখে চোখে রাখছেন মোহাম্মদকে। মোহাম্মাদের প্রতিটি কাজ দেখতে দেখতে নিজেই যেন মোহাম্মদ প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন। এমন কোমল হৃদয়ের মানুষ হয় পৃথিবীতে। মায়াসারা  কোন এক কাজে একটু অন্যদিকে গিয়েছিলেন। হঠাৎ শুনলেন মোহাম্মদের সামনে দাঁড়িয়ে এক ইয়াহুদী ব্যক্তি তর্ক করছেন। লোকটি উচ্চ সুরে বলছিল' তোমার কথার ব্যাপারে সত্যবাদী হলে তুমি লাত উজ্জা দেবতার নামে শপথ করো।  মোহাম্মদ না করলেন। যার বক্ষ বিদীর্ণ করে ভয় দেওয়া হয়েছে একত্ববাদের সুদৃঢ় সীলমোহর। যার হৃদয় কে আলোকিত করা হয়েছে ;আল্লাহর আসমাউল হুসনা দিয়ে। তিনি কিভাবে শপথ করবেন মাটির তৈরি দেবতার নামে। লোকটি যতবার মোহাম্মদ কে শপথ করতে বলছেন। মোহাম্মদ তথবার ওস্বীকার করে বলেছেন। অসম্ভব আমি কখনো এসবের নামে শপথ করব না। বরং আমি তো এগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার মুখ ফিরিয়ে নেই।

মাইসারা মোহাম্মদের কাছে এসে দাড়ালেন। কয়েকবার বলার পরও মোহাম্মদ যখন লাত ও উজ্জা নামে শপথ করলেন না। তখন লোকটি পিছু হটে মাইসারা কে টেনে এক দিকে নিয়ে গেলেন। মোহাম্মদকে দেখিয়ে বললেন কখনো তার সঙ্গ ত্যাগ করো না। কোন সন্দেহ নেই তিনি একজন নবী শেষ নবী। মাইসারা আরেকবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন যুবক মোহাম্মদের দিকে। খাদিজার কাছে বলার মত দারুন একটা তথ্য এইমাত্র তিনি আত্মস্থ করলেন। মাইসারা জানেন না তার মুগ্ধতা কেবল শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বিস্ময় নিয়ে।

সুচারুভাবে দামেস্কের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড শেষ হলো। মোহাম্মদ যে পণ্য নিয়ে এসেছিলেন দামেস্কের বাজারে বেশ ভালো দামে বিক্রি করেছেন সেগুলো। পুঁজিগত মূলধন দিয়ে এখান থেকে নতুন করে আবার পণ্য কিনে নিয়ে যেতে হবে মক্কায় বাজারে। ঘুরে সুবিধাজনক দামেই কিনতে পারলেন খাঙ্কিত পণ্য।

এবার ফেরার পালা। সব পণ্য  উঠ  ও গাধার পিঠে সাজিয়ে মক্কার পথ ধরলেন যুবক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ। দীর্ঘ পথ। একদিন দুপুর বেলা পথ ক্লান্তিতে বুশরা নামক স্থানে এসে যাত্রাবিরতি করলেন। তিনি কাফেলা থামিয়ে একটি গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। দুপুর রোদে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা করবেন মক্কার পথে। মায়সারা কাছেই বসে পড়লেন। দুপুরের খাবারের আয়োজন টা সেরে ফেলবেন এই ফাকে। এমন সময় দেখলেন দূর থেকে অপরিচিত এক বৃদ্ধ লোক হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। লোকটি তার দিকে এগিয়ে এলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বিশ্রাম রত মুহাম্মদ এর দিকে। মাইসারা লোকটির দৃষ্টির গভীরতা দেখে সচকিত হয়ে উঠলেন। লোকটিকে দেখে মাইসারা চিনলেন তিনি খ্রিস্ট বিশ্বাসী একজন পাদ্রী। লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে মাইসারার  কাছে এসে মোহাম্মদ এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন। ওই যে গাছের নিচে যে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি কে চেনো তাকে। মাইসারা কৌতুহলী হলেন, কেননা এর আগে তিনি দামেস্কের বাজারে নতুন কিছু শুনেছেন মোহাম্মদ এর ব্যাপারে। এ পাদ্রী ও কি তেমন কোন কথা বলবে। তিনি  বললেন তিনি মোহাম্মদ ইবনে আবদুলাহ। হাশিম গোএের একজন লোক। 

লোকটি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তিনি মায়সারার দিকে তাকিয়ে বললেন আমি যা জানি তুমি তা জানো না। শুনে রাখ আমি শপথ করে বলছি, এই গাছের নিচে যিনি বসে আছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।

মায়সারা আবার বিস্মিত হলেন। খাদিজা কি এ কারণেই তাকে মোহাম্মদের ছায়া সঙ্গী করে পাঠিয়েছেন। এ কারণেই কি তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করতে বলেছেন। খাদিজা কি মুহাম্মদ এর ব্যাপারে এই ভবিষ্যদ্বাণী আগে থেকেই জানেন। পাদ্রীর প্রশ্নে মায়সারার চিন্তায় ছেদ পড়লো। লোকটি মুহাম্মদ এর ব্যাপারে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। মোহাম্মদের জন্ম, বেড়ে উঠা, তার বংশ, তার পরিচয়, স্বভাব, লেনদেন, সব বিষয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন। মায়সারা সব কথার উত্তর দিলেন। মায়সারার কথা শুনে পাদ্রী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মোহাম্মদের কাছে গিয়ে বসলেন। এবং তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন৷ এবং কপালে চুমু খেলেন। এবং বললেন আমি নিশ্চয়ই সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি একজন নবী হবে যার ব্যাপারে তাওরাত ও ইঞ্জিল আছে। 

মাইসারা  পাদ্রীর কাছ থেকে কথা শুনলেন এবং তার চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করলেন। এবার তার দায়িত্ব যেন আরো বেড়ে গেল। নতুন নতুন প্রতিটি ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর। তিনি আরো মনোযোগী হয়ে মোহাম্মদের সর্ব দিকে খেয়াল দেওয়া শুরু করলেন। প্রতিটি ঘটনা খাদিজার কাছে পেশ করার উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার কাফেলা রওয়ানা  হল। মায়সারা সারা সারাক্ষণ মোহাম্মদ এর উপর চোখ রাখেন। দুপুরের তেজি রোদ দুরন্ত সূর্য যেন আগুনের হলকা ছোটাচ্ছে। পথ জুড়ে মরুর চিকচিক মরীচিকায় চোখ রাখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মায়সারা দেখলেন মোহাম্মদ যেখান দিয়ে উট নিয়ে যাচ্ছেন।সেখানে সূর্যের আলো নেই। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন-অবাক কান্ড আকাশের নীলিমা একখন্ড ধূসর মেঘের ছায়া। মোহাম্মদের মাথার উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। এছাড়া সব জায়গায় সূর্যের আলো। এ দৃশ্য দেখে মায়সারার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মনে মনে বললেন ধন্য তুমি মুহাম্মদ, ধন্য কুরাইশ রাজকুমারী খাদিজা।


খাদিজার দিন যেন ফুরায় না। প্রতিদিন তিনি মোহাম্মদের কাফেলার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। মোহাম্মদের ব্যাপারে সবকিছু জানার জন্য তিনি  উদগ্রীব। প্রতিদিন বাড়ির দুতালা থেকে তিনি চেয়ে থাকেন সিরিয়ার পথ পানে। কখন আসবে দামেশকি কাফেলা। অবশেষে কাফেলার আগমন শোনা গেল মক্কার উপকণ্ঠে। মনে মনে ভাবছেন মাইসারা কি খবর নিয়ে আসছে? কেমন আছেন মোহাম্মদ, পথে কোন বিপদ হয়নি তো। পন্যের ব্যাপারে তার মাথা ব্যাথা নেই। ব্যবসা যা হওয়ার হোক আগে মোহাম্মদের খবর শুনতে হবে। মোহাম্মদ বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সরাসরি চলে গেলেন মক্কার বাজারে। দামেস্ক থেকে আমদানি করা সমুদয় মাল মক্কার বাজারে বিক্রি করে যাবতীয় হিসাব দিতে হয় নিয়োগদাতার কাছে। এটাই নিয়ম তাই তিনি খাদিজার বাড়িতে না এসে পণ্য নিয়ে মক্কার বাজারে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যত দ্রুত তিনি এ কাজ সমাপ্ত করতে আগ্রহী।

মায়সারার সে দায় নেই ব্যবসায়িক কাজের কোন হিসাব তাকে দিতে হবে না। তার কাজ ছিল সফরে মোহাম্মদের দেখাশোনা করা। এবং তার ছায়াসঙ্গী হয়ে সবকিছু অবলোকন করা। এখন তার দায়িত্ব শেষ আর দেরি না করে তিনি চলে এলেন খাদিজার কাছে। মোহাম্মদ এর ব্যাপারে আশ্চর্যজনক সব খবর জমা করে নিয়ে এসেছেন। যতক্ষণ তিনি না জানাবেন সে পর্যন্ত শান্তি নেই। এতদিন অনেক কষ্টে বুকের মধ্যে আটকে রেখেছে অবিশ্বাস্য কথামালা। খাদিজা মায়সারার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আসতেই তাকে একান্তে ডেকে পাঠালেন, জানতে চাইলেন তার প্রতিবেদন। তিনি সবিস্তারে বলতে শুরু করলেন। একদম প্রথম থেকে দামেশকে যাওয়ার পথে যা ঘটেছে, যা ঘটেছে দামেস্কের বাজারে ইহুদি ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করার সময়, ফেরার পথে খ্রিস্টপাদ্রীর ভবিষ্যৎ বাণী, আকাশ থেকে ছায়াদানকারী সেই মেঘ খন্ড, মোহাম্মদের ব্যাবসায়িক সততা, ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে তার স্বচ্ছতা,অন্যদের সঙ্গে চারিত্রিক আচারণ, সব তিনি খুলে বললেন খাদিজার কাছে।

খাদিজার হৃদয় খুশিতে আত্মহারা হওয়ার যোগাড়। কিন্তু মায়সারার সামনে সেটা প্রকাশ করলেন না। তার সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে তাকে বিদায় করে দিলেন। এবার তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। খাদিজা মনে মনে প্রতিজ্ঞা বন্ধ হলেন। অবশেষে তার অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর শেষ হতে চলেছে। আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ এর জন্য ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলছে আজ।


খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা খুশির আহ্বান নিয়ে এলেন ওয়াকার কাছে। মায়সারার কাছে যা শুনেছেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর ব্যাপারে সব খুলে বললেন। সব শুনে ওরাকার দৃষ্টিহীন চোখেও চিকচিক করে উঠলো আনন্দ অশ্রু। তার এতদিনের অপেক্ষা তবে শেষ হলো। সেই সে মানব কে তিনি নিজ চোখে দেখতে পারবেন। না পারলেও তাকে স্পর্শ করতে পারবেন। তার কথা শুনতে পারবেন। সুযোগ হলে হয়তো তিনি তার নবুয়তের আলোতেও বিভাসিত হতে পারবেন। হতে পারবেন শেষনবীর সম্মানিত উম্মত হিসাবে।

ওয়ারাকা খাদিজা রাঃ কে বললেন বোন আমার। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তিনি এ যুগের নবী। আমি বিশ্বাস করি এই সেই সময়, যখন নবীর আগমন অবশ্যম্ভাবী। সময় সমাগত এখন কেবল অপেক্ষার পালা। সবকিছু মোহাম্মদ সাঃ এর সাক্ষ্য দিচ্ছে। সব নিদর্শন খাদিজার অনুকূলে কিন্তু খাদিজা রাঃ কি পারবেন?এখন যদি সত্যিকারের মোহাম্মদ সাঃ নবী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তাহলে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু কিভাবে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন। এমন প্রশ্ন এসে এবার বাসা বাদলা খাদিজার মনে।

মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম পণ্য বিকিকিনি শেষ হলে। একসময় তিনি সব হিসাব বুঝিয়ে দিতেন এলেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর কাছে। অন্যবার যে পরিমাণ মুনাফা হয় এবার তার চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসার মুনাফার দিকে তাকিয়ে দেখার আগ্রহ নেই। তিনি কেবল তার সামনে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর দিকে তাকিয়ে আছেন। এ যেন এক মহাকাল এর পরিচয়। 

কিন্তু খাদিজা রাঃ কিভাবে বলবেন তার হৃদয়ের অভিব্যক্ত। নিজের অপারগতায় মুষড়ে যেতে থাকেন তিনি। এতদিন মুখে বলাটা যত সহজ ছিল এখন কাজে পরিণত করাটা তার চেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। বয়সের তারতম্য বিষয়টি তো রয়েছে। তাছাড়া খাদিজা এতদিন সব বড় বড় ব্যবসায়ী, গোত্রপতি দের বিয়ের প্রস্তাব না করে দিয়েছেন। এ বয়সে বিয়ে করবেন না বলে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর প্রতি মুগ্ধতা তার সকল প্রতিজ্ঞা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এর সহধর্মীনি হোয়ার ভাগ্যের পরশমনি তার হৃদয় কে ব্যাকুল করে তুলেছে। কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।🌹

খাদিজা রাঃ সবসময় মন মরা হয়ে থাকেন। মোহাম্মদ সাঃ এর কথা ভেবে ভেবে পেরেশান হন। এত কাছে পেয়েও তিনি তাকে হারাবেন। আল্লাহর এত বড় উপহার এত কাছে আসার পরও তিনি তা গ্রহণ করতে পারবেন না। তার চোখ জুড়ে জমা হয় বেদনার অশ্রু। মাঝেমধ্যে তিনি ওয়ারাকার কাছে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকেন। ওয়ারাকা তাকে পরামর্শ দেন। আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরার জন্য।

দামেস্কের বাণিজ্য কাফেলা মক্কায় আসার পর তিন মাস হয়ে গেছে। এরমধ্যে খাদিজা রাঃ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। একবার ভেবেছেন সবকিছু পেছনে ফেলে এখন গিয়ে মোহাম্মদ সাঃ এর পানি প্রার্থী হবেন। আবার চিন্তা করছেন লোকজন কি বলবে। এমন এক ভাবনা কারো কাছে মন খুলে বলা যায় না। তিনি নিজের মনোবেদনা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। এরই মধ্যে একদিন খাদিজার অন্তরঙ্গ বান্ধবী নাফিসা এলেন তার বাড়িতে। নাফিসা বিনতে মুনিয়া সময়-সুযোগ পেলেই খাদিজা রাঃ বাড়িতে আসেন। এবার আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন তিনি বান্ধবীকে দেখতে আসেননি। কিন্তু এবারে সে খাদিজাকে কিছুটা অন্যরকম দেখতে পেলেন। এই খাদিজা রাঃ আগের সেই ব্যক্তিত্বময়ী দৃঢ় প্রত্যয়ী খাদিজা নয়। তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। তার কী হয়েছে নাফিসা মনে মনে ভাবতে লাগেন।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর অস্থিরতা দেখে নাফিসা জিজ্ঞাসা করেন কি হয়েছে। তোমার কোন সমস্যা হয়নি তো। আমি অনেকদিন থেকে তোমাকে জানি কিন্তু এমন অস্থিরতা তো তোমাকে কখনো দেখিনি। নাফিসার কথা খাদিজা রাঃ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না চুপ করে রইলেন। আবার ভাবলেন নাফিসা তো তার অন্তরঙ্গ বান্ধবী কারো না কারো কাছে তো বিষয়টি বলতেই হবে। না বললে সমস্যার সমাধান হবে না।  শেষমেষ মুখ খুললেন খাদিজা। বান্ধবী আমার আবদুল্লাহর ছেলে মোহাম্মদ সাঃ কে তো তুমি জানো। তিনি চারিত্রিক উৎকর্ষে প্রতিপালিত একজন যুবক। তার মত চারিত্রিক নিষ্কলুষতাসম্পন্ন যুবক এর আগে আমি আর দেখিনি। তিনি সৎ বিশ্বস্ত এবং পবিত্র একজন মানুষ। শুধু তাই নয় তার ব্যাপারে অনেক অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। এবং অদ্ভুত সব বিষয়ে আমি জেনেছি। আমি বিশ্বাস করি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম সেই নবী যার জন্য যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করা হচ্ছে। ও আচ্ছা" ঘটনা তাহলে এই। নাফিসা বান্ধবীর রক্তিম মুখ দেখে বিষয়টি আন্দাজ করতে পারলেন। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি লুকিয়ে আগ বাড়িয়ে বললেন হলোই বা তিনি বিশেষ কেউ। কিন্তু তার সঙ্গে তোমার এই দীর্ঘদিন রজনীর অস্থিরতার কি সম্পর্ক। তিনি এবার আর কোন বক্তব্যে গেলেন না। সরাসরি নাফিসার কাছে নিজের ইচ্ছা বললেন। আমি তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। কিন্তু জানিনা এ কাজে আমি কিভাবে এগোবো। বান্ধবীর এমন উদার আত্মসমর্পণে খুশিতে ভরে গেল নাফিসা হৃদয়। এমন শুভ কাজে নাফিসা এগিয়ে না এসে পারেন না। তিনি নিজে এ কাজের দায়িত্ব নিলেন। তোমার যদি সম্মতি হয় তাহলে এ ব্যাপারে আমি অগ্রসর হতে পারি। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বান্ধবীর সহসা সহযোগিতার কথা শুনে খুশি হলেন।অতঃপর বললেনঃ তুমি অগ্রসর হও বাদবাকি আল্লাহর হাতে।


মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তখন চাচা আবু তালিবের বাড়িতে ছিলেন। বাড়িতে আবু তালিব এবং তার স্ত্রী ও ছিলেন। এমন সময় সেখানে নাফিসা আবু তালিবের স্ত্রীকে সালাম দিয়ে নাফিসা বসে গেলেন। সেখানে একথা সেকথা জিজ্ঞাসা করলেন কিছুক্ষণ। একটু পর মোহাম্মদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। কি ব্যাপার আপনি এখনো বিয়ে করছেন না যে?

প্রশ্নটা হঠাৎ হয়ে গেল, মহাম্মদ সাঃ এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তিনি সহজভাবে জবাব দিলেন বিয়ে করার মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই আমার। তেমন অবস্থা হলে বিয়ে করে ফেলবো।

নাফিসা কথা বাড়াতে লাগলেন। অর্থ-সম্পদ বিয়ের জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। অর্থ-সম্পদ খুব সহজেই ফুরিয়ে যেতে পারে। ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সততা, বিশ্বস্থতা, সচ্চরিত্র, চিরকাল তাকে। আপনার এ বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর আগ্রহ দেখে তিনি কথা সামনে নিয়ে চললেন। অর্থ সম্পদের বিষয়টি বাদ দিন, এমন কেউ যদি আপনাকে প্রস্তাব দেয় যার পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ ও সম্মান প্রতিপত্তি রয়েছে। এবং বংশ মর্যাদায়ও যিনি অভিজাত তাহলে কি আপনি বিয়ের জন্য রাজি হবেন।

নাফিসা প্রকান্তরে বুঝাতে চাইলেন এমন একজন রয়েছেন। যিনি আপনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক। একথা শুনে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এরকম মেয়ে কে তিনি। নাফিসা এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে নামটি উচ্চারণ করলেন খাদিজা রাঃ।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজার নামটি শুনে কিছুটা অবাক হলেন। হয়তো কিছুদিন আগেই মাত্র তিনি তার ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে দামেস্ক থেকে ব্যবসা করে এলেন। খুব সংক্ষিপ্ত সময় তারা কিছু কথাও বলেছেন। কিন্তু তাই বলে খাদিজার মত সম্পদশালী নারী তাকে বিয়ে করার  ব্যাপারে আগ্রহী। মক্কার দুনিয়ার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব। সেখানে তার মত এতিমকে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সম্মানিত করতে চাচ্ছেন। তিনি একটু আশ্চর্য হয়ে নাফিসাকে জিজ্ঞাসা করলেন এটা কিভাবে সম্ভব। নাফিসা তার মুখে সম্মতির চিহ্ন দেখতে পেয়ে আর একটু সাহসী হলেন। কিভাবে সম্ভব সেটি আমার উপর ছেড়ে দিন এ বিষয়টি আমি দেখবো। নাফিসা আর কথা বাড়ালেন না বান্ধবীর জন্য এটুকু করতে পারা তার জন্য অনেক সৌভাগ্যের। বান্ধবী কে এখন সংবাদটা জানাতে হবে।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহ নাফিসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নাফিসা আসতেই তিনি জানতে চাইলেন কি ঘটলো আবু তালিবের বাড়িতে। নাফিসা সবিস্তারে তাকে জানালেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মনোভাবের কথা।নাফিসার কথা শুনে খাদিজা রাঃ চোখ বন্ধ করে ফেললেন। অদৃশ্য প্রভুর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। মনে মনে একই সঙ্গে তিনি এটাও ভাবলেন মোহাম্মদ সাঃ যেহেতু এ বিয়েতে সম্মত সুতরাং আর দেরী করা উচিত নয়। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে একটি বার্তা পাঠালেনঃ-

হে মুহাম্মদ আমার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল আমি আপনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো। কারন আমারা একই বংশের লোক। আপনার বিশ্বস্ততা, সততা, চারিত্রিক উৎকর্ষ, আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ কারণে আমি আপনার প্রতি আগ্রহী হয়েছি। আপনি আপনার চাচাকে বিবাহর সকল প্রস্তুতি করতে বলুন।

মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজার সম্মতিসূচক বার্তা জানালেন চাচা আবু তালিব কে। আবু তালিব এ সংবাদ শুনে খুশি হলেন। তিনি খাদিজার বাড়িতে গিয়ে তাকে বিয়ের জন্য মোবারকবাদ জানালেন। খাদিজার পরে  এ বিয়ে উপলক্ষে বেশি খুশি হয়েছেন আবু তালিব। তিনি তার এ ভাতিজাকে অত্যান্ত ভালোবাসতেন এবং অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি জানতেন তার এ ভাতিজার মত চরিত্রবান ও ভালো মানুষ এ পৃথিবীতে আর একজনও নেই। তাই খাদিজার মত বিদুষী নারী যখন মুহাম্মদকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন। তখন তিনি অন্য আর সবার চেয়ে বেশি খুশি হবেন। প্রাণভরে দোয়া করলেন এ অনাগত দাম্পত্যির জন্য।



মক্কায় বিয়ের আয়োজন চলতে লাগলো। কুরাইশ এবং অন্যান্য গোত্রের লোকজন জেনে গেল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তালা আনহা এর বিয়ের সংবাদ। সবাই এই বিবাহের জন্য খুশি হলেন।তবে যারা এর আগে খাদিজা রাঃ কে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। তাদের অনেকে এ সংবাদ শুনে  রাগ হল। বিশেষত, আবু জেহেল খাদিজার সঙ্গে মোহাম্মদের বিয়ের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। খাদিজা বিয়ে করার জন্য আবু তালিবের ঘরে আশ্রিত এক এতিম যুবক ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পেল না। আবুজেহেলের কথায় কারো কিছু আসে যায় না। বর -কনে দুই পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল।

রীতি অনুযায়ী বরপক্ষের অবিভাবক হিসেবে নবীজির চাচা আবু তালিব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তার বক্তব্য শুরু করলেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের ইব্রাহিম ও ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঔরসে সৃষ্টি করেছেন। তিনি সেই সত্তা যিনি আমাদের এ জাতির নেতা বানিয়েছেন। এবং পবিত্র ঘরের সেবা করার মধ্যে দিয়ে আমাদের মানবতার সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন।

ভূমিকার পর তিনি তার বাতিজার প্রশংসা বাক্য পাঠ করলেন। যখন আমার ভাই আব্দুল্লাহ এর ছেলে মোহাম্মদ এ প্রসঙ্গে আসে তখন স্বভাবতই তার সমকক্ষ কাউকে পাওয়া যাবে না। অর্থ সম্পদের দিক থেকে যদিও সে নিঃস্ব প্রায়। কিন্তু তার সততা-নিষ্ঠা বিশ্বস্থতা, সাহসিকতায়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সবার চেয়ে বেশী। সম্পত্তি একদিন শেষ হয়ে যাবে। এগুলো ক্ষণিকের উপকরণ মাত্র মানুষকে ধোকায় ফেলে রাখে। সুতরাং এখন আমি আপনাদের যে সংবাদ শুনাতে চাই তা তার প্রতি আপনাদের ভালোবাসা আরো বাড়িয়ে দেবে। তিনি আপনাদের কন্যা খাদিজাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। বিয়ের দেনমোহর হিসেবে 500 দিরহাম ধার্য করা হলো। দেনমোহরের অর্ধেক বিয়ের আগে পরিশোধ করা হবে এবং বাকি অংশ বিয়ের পর পরিশোধ করা হবে। আবু তালিব এটুকু বলে বসে পড়লেন। এবার কনে পক্ষের অভিভাবকের বলার পালা। খাদিজা রাঃ এর পিতা খোয়াইলিদ ইবনে আসাদ বেশ আগেই ফিজার যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মত খাদিজা ও এতিম। তার সার্বিক অভিভাবক তার চাচা ওমর ইবনে আসাদের হাতে সুপর্দ। তার চাচা এবার উঠে দাঁড়ালেন সমবেত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আমাদের আরবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়িয়েছেন। যেমনটি আপনি বলেছিলেন আমরা আরবের মধ্যে তেজোদীপ্ত গোত্র আপনারাও তাই।কেউই আপনাদের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করতে পারবেন না। সুতরাং হে কুরাইশ বংশের সম্মানিত উপস্থিতি, আপনাদের সাক্ষী রেখে সেই সম্মানিত সত্তার নামে আমি খোয়াইলিদের কন্যা খাদিজাকে আব্দুল্লাহর ছেলে মোহাম্মদের হাতে তুলে দিলাম। এবং দেনমোহর হিসাবে প্রস্তাবিত পরিমাণ কবুল করে নিলাম।


বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। এবার বিয়ের ওলিমা ও উৎসবের পালা। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা কোন কিছুর কমতি করলেন না আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য উট ও দুম্বা জবাই করা হয়েছে। মক্কার গণ্যমান্য অনেককেই দাওয়াত করা হয়েছে। বিয়েতে নানা পদের সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হলো সবাইকে। মক্কার ছোট ছোট বাচ্চারা দফ ও তাম্বুরি বাজিয়ে নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করছিল। আরবের গোত্রীয় সংগীত গাইছিল মেয়েরা, সারাদিন উৎসবে রঙিন হয়ে রইল। খাদিজা রাঃ  তবে এত আনন্দ উৎসবের মাঝেও তিনি স্বামী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর উপস্থিতির ব্যাপারে সামান্য খেয়াল হারাননি। সবকিছুর বাইরে একটা চোখ তিনি সব সময় তার দেখা সোনার উপর রেখে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর স্বজন আত্মীয় যাকে পেয়েছেন তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছেন বিয়ের উৎসবে। এমনকি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ইসলামের দুধমাতা হালিমা সাদিয়া কে দাওয়াত করে নিয়ে আসতে ভুল করেননি। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা ভুলেননি এই হালিমার দুধ পান করে মোহাম্মদ সাঃ বড় হয়েছেন। তার শৈশবের পাঁচটি বছর কেটেছে হালিমার কোলে। মুহাম্মদ সাঃ কে ভালবাসার প্রতিদান স্বরূপ তিনি হালিমা কে চল্লিশটি ভেড়া উপহার দিলেন। এবং তাকে প্রতিপালন করার জন্য কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করলেন। বিদায় বেলার সম্মানার্থে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা হালিমাকে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে এলেন।

খাদিজা ভুলে যাননি বারাকাহ কেও, যিনি উম্মে আয়মান নামে প্রসিদ্ধ। উম্মে আয়মান ছিলেন নবীজির পিতা আবদুল্লাহর ক্রীতদাস। ক্রীতদাস হলেও তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর পালক মাতা হিসেবে খাদিজা রাঃ তাকে পরম মমতায় নিজে পরিবারভুক্ত করে নেন।

উম্মে আয়মান এর জীবন কাহিনী একদিকে যেমন বেদনাবিধুর তেমনি ঈর্ষণীয়। উম্মে আয়মান এর বাড়ি ছিল ইথিওপিয়ায়, সেখান থেকে দুর্ভাগ্যক্রমে দাসী হিসেবে বিক্রি হয়ে যান। দাস বাজারে আব্দুল্লাহ সদয় হয়ে থাকে নিজের ক্রিতদাসি হিসেবে কিনে আনেন উম্মে আয়মান এসময় নিতান্ত বালিকা। উম্মে আয়মান কে কিনে আনার দু'সপ্তাহ পর আব্দুল্লাহ বিয়ে করেন ইয়াসরিব নিবাসী আব্দুল ওয়াহাবের কন্যা আমিনা কে। বিয়ের পর তিনি ক্রীতদাসী উম্মে আয়মান কে নববধূ আমিনার হাতে তুলে দেন। চমৎকার একটি জুটি এবং দারুণ প্রেমময় হয়েছিল তাদের নতুন সংসার। কিন্তু অচিরেই এ সংসারে নেমে আসে বেদনার রাশি। উম্মে আয়মান  নিজেই বর্ণনা করেন, বিয়ের দুই সপ্তাহ পর আব্দুল্লাহ পিতা আব্দুল মুত্তালিব ছেলের ঘরে এসে তাকে ব্যবসা উপলক্ষে সত্বর দামেস্ক অভিমুখী সঙ্গী হতে বলেন। আব্দুল্লাহ তার পিতার একান্ত বাধ্যগত সন্তান তার পক্ষে তার পিতার কথার অবাধ্য হওয়া সম্ভব নয়। তিনি ব্যবসা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। কিন্তু নবপরিণীতা আমিনা এটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না।উম্মে আয়মান বলেন পিতা আব্দুল মুত্তালিবের এমন আদেশ শুনে আমিনা কেঁদে উঠেন। এবং বলতে থাকেন কি আশ্চর্য এমন হবে কেন আমার স্বামী কিভাবে আমাকে রেখে ব্যবসার জন্য সিরিয়ায় যেতে পারেন। আমি এখনো নতুন বধু আমার হাতের মেহেদি পর্যন্ত শুকায়নি। কিন্তু আব্দুল্লাহকে যেতেই হবে এটা তাদের পারিবারিক মৌসুমী ব্যবসা। আব্দুল্লাহর বাণিজ্য যাত্রা আমিনার হৃদয়টা ভেঙ্গে চুরমার করে দে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন। উম্মে আয়মান বলেন আমি যখন আমিনাকে এমন অবস্থায় দেখতাম।তার কাছে গিয়ে বলতাম হে আমার মালিকা, আমিনা বেদনা চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতেন। কান্না নিয়ে আমাকে বলতেন বারাকা আমাকে বিছানায় নিয়ে যাও আমি আর পারছি না।

বালিকা উম্মে আয়মান এ সময় নবপরিনিতা আমিনার সর্ব সঙ্গী হয়ে উঠেন। বিষন্নতায় বিহ্বল আমিনা অধিকাংশ সময় নিজের ঘরে একাকী থাকতেন। কারো সঙ্গে দেখা করতেন না, কথা বলতেন না, একমাত্র আব্দুল মুত্তালিব এলে কেবল তার সঙ্গে কথা বলতেন। উম্মে আয়মান বলেন আব্দুল্লাহ দামেশকে যাত্রার দুই মাস পর এক বিমুগ্ধ সকালে আমিনা আমাকে ডেকে বলেন। বারাকা আমি তো এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি। আমি বললাম নিশ্চয়ই ভালো কিছু আমার মালিকা। আমিনা বলেন আমার গর্ভ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে অলৌকিক আলো,সে আলো মক্কার চারপাশের পাহাড়, জনপদ ও মরুভূমি কে আলোকিত করে তুলছে। আমি হয়রান হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি গর্ভবতী মালিকা, তিনি লজ্জা রাঙ্গা হয়ে বললেন হ্যাঁ বারাকা। কিন্তু আমি তেমন কোনো অস্বস্তি অনুভব করছি না যেমনটি অন্য মেয়েরা করে থাকে। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম আপনি এক বরকতময় শিশুর জন্ম দেবেন যে আলোকিত করবে সমাজকে। আব্দুল্লাহর বিরহে আমিনা কাতর গর্ভকালীন সময়টাতেও তিনি নিজেকে অন্য সবার কাছ থেকেও গুটিয়ে রাখতেন। আর উম্মে আয়মান নানা ধরনের হাস্যত্বক  কাহিনী ও কবিতা শুনিয়ে খুশি রাখতে চেষ্টা করতেন।



রই মধ্যে একদিন হন্তদন্ত হয়ে আব্দুল মুত্তালিব এলেন আমিনার ঘরে। জানালেন এখনই তাকে মক্কার পাশের পাহাড় চূড়ায় আশ্রয় নিতে হবে।আবরাহা নামে ইয়েমেনের এক বাদশা তার বিশাল হস্তী বাহিনী নিয়ে এসেছে মক্কা আক্রমণের জন্য। সে আল্লাহর ঘর কাবা কে ধুলিস্যাৎ করারা অভিপ্রায় নিয়ে আসছে। মক্কার কাউকে সে ছাড়বে না নিরাপত্তার জন্য মক্কার সবাই পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

আমিনা শ্বশুরের কথায় বিন্দুমাত্র ভীত হলেন না। তিনি স্পষ্ট করে বললেন স্বামীর ঘর ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না ।আল্লাহর ঘর কাবা কে ধ্বংস করার ক্ষমতা কারো নেই ।আল্লাহর ঘর আল্লাহ রক্ষা করবেন। আব্দুল মুত্তালিব আমিনার চেহারায় এমন আত্মবিশ্বাসের ছায়া দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। অগত্যা তিনি তাঁকে মক্কায় রেখে অন্যান্য মক্কাবাসীকে নিয়েই পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে আশ্রয়ে চলে গেলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিনার কথাই সত্য হলো, আব্রাহার সেনার  হাতি বাহিনী সামান্য পাখির ডাকের ছুঁড়ে দেওয়া পাথরের আঘাতে তৃণের মতো মক্কার উপকণ্ঠে মরে পড়ে রইল।

দিনরাত পুরোটা সময় উম্মে আয়মান আমিনার পাশেই থাকতেন। তিনি বলেন আমি তার পায়ের কাছে ঘুমাতাম এবং তিনি যখন তার স্বামীর নাম ধরে থাকতেন তখন আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।

কিছুদিন পর দামেস্ক থেকে বানিজ্য কাফেলা ফিরে এলো। আব্দুল্লাহ এসেছেন কিনা এটা জানতে বালিকা উম্মে আয়মান আব্দুল মুত্তালিবের বাড়ির ভিতরে গিয়ে কান পাতলেন। কিন্তু সেখানে আব্দুল্লাহ ফিরে আসার কোন সংবাদ পেলাম না ।তারপর তিনি ফিরে এলেন কিন্তু আমিনা কে কিছু জানাননি ।একদিন পুরাপুরি কাফেলা মক্কায় এসে গেল কিন্তু আব্দুল্লাহ এলেন না।

স্বামীর অপেক্ষায় আমিনা অস্থির। উম্মে আয়মান আবার একদিন গেলেন আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে। এবার তিনি শুনতে পেলেন এমন এক সংবাদ। যার জন্য তিনি তো বটেই, মক্কার কেউই প্রস্তুত ছিল না ।শুনলেন মক্কার ফেরার পথে আব্দুল্লাহ মদিনার কাছাকাছি এসে পথিমধ্যে রুগে মারা গেছেন ।তিনি বলেন এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। আমি ভাবতে পারলাম না আমি, আমিনাকে এ সংবাদ কিভাবে দেব। আব্দুল্লাহ আর কখনো ফিরে আসবেন না। যার জন্য মক্কার এক কুটিরে অপেক্ষা করছেন তার প্রিয়তমা ও অনাগত সন্তান।

আমিনা যখন এ সংবাদ শুনলেন চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমি তার পাশেই ছিলাম। ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না ।আমি তার সেবায় লেগে গেলাম ।সেই দিনগুলোতে আমি হয়ে উঠছিলাম তার বান্ধবী, তার অভিভাবক,, তার চিকিৎসক, সেদিন পর্যন্ত যেদিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরাজাম মুনিরের আলো নিয়ে ধূলির ধরায় জন্ম নিয়েছিলেন। আমিনার কোলে মোহাম্মদ সা: ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সর্বপ্রথম তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন বারাকাহ, উম্মে আয়মান। একটু পর তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব এসে নাতিকে কুলে করে নিয়ে গেলেন কাবা চত্বরে। এবং অত্যান্ত আনন্দ করে বললেন আমারে এ নাতির নাম আজ থেকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেখানে তিনি সকল মক্কাবাসীকে নিয়ে নতুন শিশুর আগমনের উৎসব পালন করলেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো উম্মে আয়মান এর কুলে ছিলেন। যখন হালিমা সাদিয়া তাকে মক্কার বাইরে স্বাধীন মরুর তাবু-জীবনে নিয়ে যান। পাঁচ বছর পর যখন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ফিরে আসেন আমিনার কোলে, তখন আমিনার সঙ্গে আমিও তাকে বুকে জড়িয়ে নেই। মোহাম্মদ সা: এর বয়স যখন ছয় বছর তখন আমিনা তার শিশুকে নিয়ে ইয়াসরিবে স্বামীর কবর জিয়ারতের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আব্দুল মুত্তালিব এবং উম্মে আয়মান যদিও তাকে সেখানে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একদিন সকালবেলা আমিনা, উম্মে আয়মান এবং শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম সিরিয়া গামী এক কাফেলার সঙ্গে রওয়ানা হন। এবং ইয়াসরিবের পথে যাত্রা করলেন। একই উটের হাওদায় চড়ে তারা তিনজন চললেন।

দশ দিন সফর শেষে তারা ইয়াসরিবে পৌঁছলেন। আমিনা পুত্র মোহাম্মদ কে তার মামাদের কাছে রেখে স্বামীর সমাধি জিয়ারত করতে গেলেন। ভালোবাসার বেদনার নোনা জলে ভিজিয়ে দিলেন প্রিয়তমা আব্দুল্লাহর কবরের শুষ্ক মাটি। ইয়াসরিবে কয়েক সাপ্তাহ অবস্থানকালে তিনি প্রায় দিন স্বামীর কবরের পাশে বসে অঝোরে কাঁদতেন।

ইয়াসরিবের কয়েকসপ্তাহ অবস্থান করে আমিনা মক্কায় ফেরার সফর শুরু করলেন। ইয়াসরিব থেকে মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে আবওয়া নামক স্থানে আসার পর। আমিনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তার অসুস্থতা দ্রুত অবনতির দিকে যেতে লাগল। তার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। তার অসুস্থতার দরুন তিন সদস্যের এ কাফেলা সেখানেই যাত্রাবিরতি করতে বাধ্য হল। এসময় আমিনা উম্মে আয়মান কে নিজের কাছে ডাকলেন। উম্মে আয়মান বর্ণনা করেন আমিনা আমাকে ডেকে বললেন বারাকাহ, শুনো আমার জীবনের মঞ্জিল হয়তো শেষ হয়ে এসেছে। জীবন থেকে আমারও হয়ে গেছে সময়, বিদায় নেওয়ার। আমার বুকের ধন মোহাম্মদ কে তোমার বুকে রেখে গেলাম। আজ থেকে তুমি তার মা তুমি তার সব। সে যখন আমার গর্ভে ছিল তখন হারিয়েছে পিতাকে আর এখন চোখের সামনে নিজের মাকেও চলে যেতে দেখছে। তুমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এতিম মোহাম্মদের মা হয়ে থেকো। কখনো তাকে ছেড়ে যেও না। আলবিদা! আমিনা নিজ শহর মক্কা থেকে বহুদূরে, বাবার বাড়ি ইয়াসরিব থেকে অনেক দূর, আবওয়া নামক এক জনশূন্য মরু বিয়াবানে নিজের জীবনের শেষ সফরের পাঠ চুকিয়ে বিদায় নিলেন। পৃথিবী থেকে প্রভুর ডাকে সাড়া দিলেন।


মা হারিয়ে 6 বছরের বালক মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লেন তাঁবুর নিচে। ক্রীতদাসী উম্মে আয়মান নিজ হাতে কবর খুরলেন আমিনার জন্য। কোথাও কেউ নেই উম্মে আয়মান নিজেই কবরে শোয়ালেন তার মালিকিন কে। তার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা মাটি চাপা দিলেন বুকে পাথর বেঁধে। জনমানবহীন আবহাওয়া নামক প্রান্তরে কান্না চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রভুর কাছে আরতী করলেন। তোমার আমিনা কে তোমার কাছেই রেখে গেলাম হে অবিনশ্বর।

চিৎকার করে কাঁদতে থাকা ছোট্ট মুহাম্মদ সাঃ কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে উম্মে আয়মান অবিন্যস্ত পায়ে হাঁটতে লাগলেন মক্কার পথে। না বারাকা কখনো মুহাম্মদ সাঃকে ছেড়ে যাননি। ছোট্ট শিশুটি থেকে তাকে মমতার চাদরে জড়িয়ে রেখেছিলেন জীবনভর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমিনাকে দেওয়া তার কথার বিন্দুমাত্র বর খেলাপ করেননি তিনি।

উম্মে আয়মান সদ্য মা হারানো এতিম বালক মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম কে বুকে আগলে মক্কায় চলে এলেন। তাকে অর্পণ করলেন তার দাদার কাছে তিনি নিজেও রয়ে গেলেন মোহাম্মদের মা হয়ে। দুই বছর পর আব্দুল মুত্তালিব মহাম্মদ সাঃ কে একা কি করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। চাচা আবু তালিব ভালোবাসার  দিয়ে বুকে টেনে নিলেন ভাতিজাকে উম্মে আয়মান ও রয়ে গেলেন তার সঙ্গে। তাকে বালক থেকে কিশোর। কিশোর থেকে গড়ে তুললেন পরিপূর্ণ এক যুবক।

মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম যখন খাদিজাকে বিয়ে করেন। বিয়ে উপলক্ষে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম তার এই মা তুল্য ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিলেন। উম্মে আয়মান স্বাধীন হওয়ার পরও মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে ছেড়ে যাননি। তিনি নবীজির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি কখনো তাকে ছেড়ে যাবো না সেও কখনো আমাকে ছেড়ে থাকবেনা। মোহাম্মদ সাঃ বড় ভালোবাসতেন তার এ মাকে। বড় সম্মান করতেন উম্মে আয়মান কে। বিয়ের পর একদিন  মুহাম্মদ সাঃ উম্মে আইমান কে ডেকে বললেন ও মা এখন তো আমি বিয়ে করে ফেললাম। কিন্তু তুমি তো এখনো অবিবাহিতা! কেউ যদি এখন তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে আপনার মতামত কি। উম্মে আয়মান তার দিকে তাকিয়ে বললেন আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না। কোন মা কি তার সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারে। মোহাম্মদ সাঃ অশ্রুভেজা চোখে হাসলেন। এরপর তিনি সদ্য পরিনিতা খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললেন। এ হচ্ছে বারাকা, আমার মায়ের মৃত্যুর পর সেই আমার মা হিসেবে আমাকে বড় করেছেন। সেই আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকালেন উম্মে আইমানের দিকে। তাকে কাছে টেনে বললেন বারাকাহ মোহাম্মদের জন্য এত আত্যাতেগ করেছো যা তুলনাহীন। এখন মোহাম্মদ সে আত্যাতেগের সামান্য কিছু বিনিময় তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আমি এবং মুহাম্মদ দুজনেই অনুরোধ করছি বয়স পেরিয়ে যাওয়ার আগে বিয়েটা করে ফেলো। উম্মে আয়মান লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কে আমাকে বিয়ে করবে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন ইয়াসরিব থেকে ওবায়েদ ইবনে যায়েদ এসেছেন তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তিনি তোমাকে বিয়ে করতে চান তাকে বিমুখ করো না।


উম্মে আয়মান এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে ওবায়েদ ইবনে জায়েদকে বিয়ে করলেন। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে ইয়াসরিবে চলে যান। কিছুদিন পর তিনি সেখানে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন যার নাম রাখা হয় আয়মান। এ আয়মানের নাম অনুসারে তাকে উম্মে আয়মান বলে ডাকা হতো। উম্মে আয়মানের এ স্বামী-সংসার বেশি দিন স্থায়ী হল না। পুত্র আয়মানের জন্মের কিছুদিন পর তার স্বামী উবায়েদ ইবনে যায়েদ মৃত্যুবরণ করেন। এবং তিনি পুনরায় মক্কায় তার ছেলে মোহাম্মদ সাঃ এর কাছে চলে আসেন।

মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রাপ্ত হন তখন উম্মে আয়মান ইসলাম গ্রহণ করে প্রথম সারির মুসলিম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ইসলামের জন্য তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেন। নবুয়তের কাজে নানাভাবে তিনি রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সাহায্য করতেন বিশেষত, মক্কার পৌত্তলিকরা কোথাও কোন মুসলিমকে নির্যাতন করলে বা রাসুলের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করলে। তিনি এবং যায়েদ ইবনে হারেসা সেসব সংবাদ সংগ্রহ করে রাসুলকে জানাতেন।

নবুয়তের প্রথম দিকে এক রাতে মক্কার পৌত্তলিকরা দারুল আরকামের চারপাশ ঘিরে ফেলে, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ করছিলেন এবং তাদের ইসলামের বিষয়াবলী শিক্ষা দিচ্ছিলেন। এমন সময় রাসূলের স্ত্রী খাদিজা রাঃ জরুরী একটা সংবাদ দিয়ে উম্মে আয়মান কে রাসূলের কাছে পাঠান। তিনি বহু কষ্টে পৌত্তলিক দের চোখ ফাঁকি দিয়ে দারুল আরকামে গিয়ে রাসূলের কাছে  সংবাদটি পৌঁছান।

তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ টি শুনে রাসুল অত্যন্ত খুশি হন এবং বলে উঠেন তোমার আগমন শুভ হোক এর বিনিময়ে তোমার জন্য বেহেশতে একটি প্রসাদ পাওনা রইল। উম্মে আয়মান খুশি হলেন। যখন তিনি দারুল আরকাম থেকে চলে এলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন যদি তোমরা কেউ বেহেশতী কোন রমণীকে বিয়ে করতে চাও, তবে সে যেন উম্মে আয়মান কে বিয়ে করে। উম্মে আয়মান এর বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি, তিনি তেমন সুন্দরী ছিলেন না, এবং আকর্ষণীয় নয়। রাসুলের পালক পুত্র যায়েদ ইবনে হারেসা দাঁড়িয়ে পড়লেন। এবং বললেন হে আল্লাহর রাসূল, আমি উম্মে আয়মান কে বিয়ে করতে চাই তিনি রূপবতী অনেক রমণীর চেয়েও উত্তম।

জায়েদ এবং উম্মে আয়মান এর বিয়ে হয়ে গেল। কিছুদিন পর তাদের ঘরে এক পুত্র সন্তান হয় যার নাম রাখা হল উসামা। রাসুল সাঃ অত্যান্ত স্নেহ করতেন উসামা কে। তিনি তাকে কোলে নিয়ে ঘুরতেন, তার সঙ্গে খেলা করতেন, নিজ হাতে খাওয়াতেন। রাসুলের সাহাবীরা বলতেন সে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এক শিশু।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন তখন উম্মে আয়মান কে মক্কায় রেখে যান। কেননা রাসুলের বাড়িতে তখন তার মেয়ে ও পরিবারের অন্য সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। তাদের দেখাশুনার জন্য উম্মে আয়মান মক্কায় রয়ে যান। হিজরতের 3 মাস পর তাদের নেওয়ার জন্য রাসুল সাঃ যায়েদ ইবনে হারেসা এবং ক্রীতদাস আবু রাফে কে পাঠান। উম্মে আয়মান রাসুলের দুই কান্না উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা, আবু বকর এর পরিবার এবং নিজের সন্তান উসামাকে নিয়ে মদিনার পথে যাত্রা করেন।

যাত্রাপথে বহনের স্বল্পতার কারণে উম্মে আয়মান দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দেন। মরুভূমির তপ্ত বালি পাড়ি দেওয়ার ফলে তার পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। গনগনে রুদের নিচেহাঁটার ফলে তার চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। দীর্ঘ যাত্রার পর যখন তিনি মদীনায় পৌঁছেন তখন তার পা ছিল ক্ষতবিক্ষত শরীর জুড়ে ধুলোবালিয়ে মুখে হয়ে গিয়েছিল রুদ্র তামাটে। তাকে এ অবস্থায় দেখে রাসুল সাঃ দৌড়ে এসে তার পাশে বসে, বলতে থাকেন ও উম্মে আয়মান ও আমার মা তোমার প্রতিদান তো কেবল বেহেশত ছাড়া আর কিছু নয়। রাসুল পরম মমতায় উম্মে আয়মান এর মুখ ও চোখ থেকে সকল ক্লান্তি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজ হাতে তার ক্ষতবিক্ষত পা মালিশ করে দেন।

মদিনায় উম্মে আয়মান নতুন করে তার সংসার শুরু করলেন। এ সময় ইসলামের জন্য নিজেকে আত্মনিবেদিত করে দেন। উহুদের যুদ্ধে শত্রুর তীর বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের পানি পান করান এবং আহতদের চিকিৎসা করেন। খায়বার ও হুনায়নের যুদ্ধেও তিনি রাসুলের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর প্রথম ছেলে আয়মান হিজরতের অষ্টম বছর বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তার দ্বিতীয় স্বামী রাসুলের ভালোবাসার পালক পুত্র যায়েদ ইবনে হারিসা সিরিয়ায় মুতার যুদ্ধে সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ করে শহীদ হন। এ সময় উম্মে আয়মান এর বয়স হয়েছিল 70 এর কাছাকাছি। রাসুল সাঃ প্রায় তার দুই বন্ধু আবু বকর ও উমর কে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করতেন ও আমার মা কেমন আছো তুমি। উত্তরে উম্মে আয়মান বলতেন ব্যাটা আমি ভালো আছি। ইসলাম আমাকে অনেক দামি করেছে। রাসুলের ইন্তেকালের পর প্রায় তিনি কাঁদতেন কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করত কেন আপনি কাঁদছেন। তিনি বলেন আল্লাহর কসম আমি জানতাম একদিন আল্লাহর রাসূল ইন্তেকাল করবেন। কিন্তু আমি এখন কাঁদছি, কারণ আরশ থেকে নেমে আসা ঐশী বাণী আমাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।

বারাকা উম্মে আয়মান একমাত্র মানুষ যিনি রাসুল মোহাম্মদ সাঃ এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন রাসূলের ভালবাসায়। রাসূল এবং ইসলামের জন্য তার আত্মত্যাগ চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইসলামের ইতিহাসে। এই মহিষীনারী হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খেলাফতের সময় ইন্তেকাল করেন।

মোহাম্মদের সঙ্গে বিয়ের কিছুদিন পর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু নিজের পুরনো বাড়ি ছেড়ে তার ভাতিজা হাকিম ইবনে হিজামের উপহার দেওয়া বাড়িতে উঠে আসেন। বাড়িটি বড় ছিল এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ছাড়াও এ বাড়িতে আরো কয়েকজন সদস্য একসঙ্গে থাকতেন। খাদিজা রাঃ কে এমনিতেই আরবের রাজকুমারী বলে ডাকা হতো সত্যিকার অর্থেই তিনি সকলের জন্য ছিলেন উদার। এ কারণে তার বাড়ি সব সময় সরগরম হয়ে থাকতো আত্মীয়-স্বজনের পদভারে। সংক্ষেপে বাড়ির সদস্যদের পরিচয় জেনে নেওয়া যাকঃ

খাদিজার প্রথম স্বামী আবু হালার ঔরসজাত ছেলে হিন্দ থাকতেন তার সঙ্গে। দ্বিতীয় স্বামী আতিক ইবনে আইয়াদের ঔরসজাত মেয় হিন্দাও থাকতেন তার পরিবারে। বিয়ের কিছুদিন পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আবু তালিব তার ছেলে আলী কে মোহাম্মদ সাঃ ও খাদিজা রাঃ পরিবারে প্রতিপালনের জন্য অনুরোধ করেন। নবীজি খুশিমনে চাচাতো ভাই আলী কে তার পরিবারের সামিল করে নেন। কেননা কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি এ চাচার পরিবারেই মানুষ হয়েছেন।

জুবায়ের ইবনে আওয়াম। জুবায়ের এর পিতা আওয়াম একদিক থেকে খাদিজার বড় ভাই অন্যদিকে তার মা ছিলেন মোহাম্মদের ফুফু। দুদিক থেকেই তিনি এ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত ছিলেন বিদায় তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি এ পরিবারে বেড়ে উঠেন।


রাসুলের নবুওয়াত ঘোষণার পর একদম প্রথমদিকে মুসলিম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন যে সৌভাগ্য বান। জুবাইর ইবনে আওয়াম তাদের একজন। মাত্র 12 বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি বেড়ে ওঠেন সরাসরি রাসুলের তত্ত্বাবধানে। ইথিওপিয়ায় হিজরতকারী দের সঙ্গী ছিলেন তিনি সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে তিনি মদীনা হিজরত করেন। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে বদর প্রান্তরে ইসলামের পক্ষে সর্বপ্রথম তার তরবাড়ি কোষমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে ফেরেশতারা তার আকৃতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন প্রত্যেক নবীর একজন প্রতিচ্ছায়া তাকে, আমার প্রতিচ্ছায়া জুবায়ের। পৃথিবীতে তাকতেই  যে দশজন সাহাবী বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন জুবায়ের তাদের একজন। রাসুলের ইন্তেকালের পর তিনি মুসলিম জাতির অন্যতম নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খেলাফতের পর খলিফা নির্বাচনের ছয় সদস্যের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি।

হাকিম ইবনে হিজাম ছিলেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার ভাতিজা। ফুফু খাদিজার  সার্বক্ষণিক ব্যবসায়ীক সহযোগী ছিলেন তিনি। খাদিজাকে তিনি মায়ের মত ভালবাসতেন। খাদিজা রাঃ যে কোন বিপদ আপদে তিনি এগিয়ে আসতেন। অত্যান্ত সচ্ছল পরিবারে বেড়ে উঠেন হাকিম। তিনি নিজেও ছিলেন বুদ্ধিমান ভদ্র ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তাই গোত্রের লোকজন তাকে নিজেদের নেতা বানিয়ে 'রিফাদাহ' এর মত সম্মানজনক পদে ভূষিত করেছিল। রাসুলের নবুয়ত প্রাপ্তির অনেক আগ থেকেই হাকিম তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। রাসূলের চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড় হলেও তিনি তার কাছে আসা যাওয়া করতেন নিয়মিত।

যখন রাসুলের সঙ্গে খাদিজা রাঃ বিয়ে হয়। তখন আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে হাকিমের সেই অন্তরঙ্গতা আরো সুদৃঢ় হয়। নবুয়তের পড়ও খাদিজার বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল। মক্কার কাফেররা যখন আবু তালিব গিরিখাদে বয়কট করে রাখে। তখন হাকিম গুপনে মুসলমানদের সাহায্য করতেন। প্রয়োজনীয় খাবার ও রসদ পৌঁছে দিতেন তাদের কাছে। নিজের ফুফুর সামান্য কষ্ট ও তিনি সহ্য করতেন না।

মক্কার কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত হুনাইনের যুদ্ধের পর মোহাম্মদ সাঃ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে হাকিমকে 100 উট উপহার দেন। এর মাধ্যমে তিনি হাকিমের মনে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা উদগত করতে চেয়েছিলেন। মোহাম্মদ সাঃ খাদিজা রাঃ এরসাথে এত চমৎকার সম্পর্কের পরও আশ্চর্যের কথা হলো তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন মক্কা বিজয়ের পর। অথচ ততদিনে রাসুলের নবুওয়াত প্রাপ্তির 20 বছর কেটে গেছে। মোহাম্মদ সাঃ মক্কা বিজয়ের দিন ঘোষণা করেন যারা হাকিম ইবনে হিজামের ঘরে আশ্রয় নেবে তাদের ক্ষমা করা হবে। অথচ তখনও হাকিম মুসলিম হননি। মক্কা বিজয়ের পর যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মুসলমান হওয়ার পর নিশ্চয়ই তুমি পূর্বের অনেক শুভ কাজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছো।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা ও মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন যায়েদ ইবনে হারেসা। ক্রীতদাস বালকের জীবন কাহিনী যেন এক রূপকথা। মোহাম্মদ পরিবারের  তার অন্তর্ভুক্ত থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাসুলের স্নেহছায়ায় ধন্য এক পুরুষ।ইতিহাসের তাকে স্মরণ করেছে বড় সম্মান দিয়ে।

জায়েদের পরিচয়টা জানতে হলে আরেকটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। চলে যেতে হবে আরব থেকে আরেকটু দূরে লোহিত সাগরের পাড়ে। লোহিত সাগরের তীর ঘেষা দক্ষিণ আরবের ইয়ামেন অঞ্চল। ইয়ামেনের এই অঞ্চলেই প্রভাবশালী গোত্র বনু কুজায়ের বাস গোত্রপ্রতি হারিসা ইবনে সুরাহা বিল, স্ত্রী সুদা বিনতে সালাবাহও আরবের আরেক বিখ্যাত তায়ি গোত্রের কন্যা। ইতিহাসখ্যাত হাতিম তায়ি এক গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ দম্পতির আদরের পুত্র জায়েদ।

জায়েদের মা সুদা বেশ কিছুদিন ধরে বাবার বাড়ি যেতে পারছিলেন না। সময়টা ছিল নিরাপত্তাহীন চারিদিকে লুটপাট মানুষের জীবনের নৈমিত্তিক। সেখানে এত দূরের পথ নিরাপদে পাড়ি দেওয়া টা কঠিন। হারিছা ব্যস্ততার ফাঁকে সময় দিতে পারেন না। তাই 8 বছরের বালক জায়েদ কে নিয়ে মা সুদা একদিন এক কাফেলার সঙ্গে বাবার বাড়ির পথ ধরেন। স্ত্রী-সন্তানকে উটের পিঠে বসিয়ে বিদায় দেওয়ার সময় হারিসার বুুকে কেমন যেন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে। ঠিকমতো পৌঁছতে পারবে তো, ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন হারিছা। পথে কোন সমস্যা হলো না নিরাপদে মা পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে। খবর পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন হারিছা। কিন্তু বিধির বিধান না যায় খন্ডন পথের বিপদ বাড়িতে এসে পড়ল। এক রাতে বনু তায়ি বসতির উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বনু কাইনের দুর্বৃত্তরা। অন্য অনেকের সঙ্গে অপহৃত হন জায়েদ, তাকে তুলে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। সন্তান হারিয়ে বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়েন সুদা।


আরবে দাস ব্যবসা শেষ সময় রমরমা অবস্থা। আর উকাজ হচ্ছে সে ব্যবসার এক লোভনীয় বাজার। দেদার বিক্রি হয় দাস-দাসী কারো কোন বাছবিচার নেই। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার ভাগ্নে হাকিম ইবনে হিজাম এসেছেন উকাজ বাজারে। ফুফু খাদিজার বিয়ে উপলক্ষে একটি ভালো উপহার কিনতে এসেছেন। অনেকক্ষণ ঘুরে তিনি ভালো দেখে তিনি কিছু ক্রীতদাস কিনে নিলেন। মক্কায় ফুফুর বাড়িতে নিয়ে এলেন সব ক্রীতদাস কে, ফুফুর সামনে হাজির করে বললেন যাকে পছন্দ হয় নিয়ে নিন। আপনার জন্য এই আমার সামান্য তোহফা। ফুফু খাদিজা বেছে নিলেন নিষ্পাপ চেহারার এক দাসবালক। সে বালক কে স্বামীর সেবার জন্য নিয়োজিত করলেন। এ বালকটি জায়েদ, একদিন যিনি ইসলামের ইতিহাসের বহুলাংশে মিশে যান যায়েদ ইবনে হারেসা নামে।

মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো নবুয়ত প্রাপ্ত হন নি। নবী হিসেবে তখন আবির্ভাব ঘটেনি তার। সেসময় তিনি সমাজের মানুষের উপকারে ব্যস্ত। একদিকে হিলফুল ফুজুল এর মাধ্যমে সমাজের দুঃখী  ও অত্যাচারীর পাশে দাঁড়াচ্ছেন। অন্যদিকে এর স্থায়ী সমাধানের পথ অনুসন্ধানে একটু একটু করে খুদার দেয়ানে মগ্ন হয়ে উঠছেন।

এমন সময়টাতেই জায়েদ এলেন খাদিজা রাঃ এর পরিবারের। এসে মুনির হিসাবে পেলেন মোহাম্মদ সাঃ কে। কয়েকদিনেই কিশোর জায়েদ এই ব্যক্তির ভালোবাসার স্নেহ পেয়ে তার ভক্ত হয়ে গেলেন। আকর্ষণীয় এক মুনিব পেয়ে নতুন জীবন শুরু হল জায়েদের। আরবের অন্য মনিবরা যেখানে ক্রীতদাসদের পশুরা অধম মনে করে, সেখানে জায়েদ তার মালিকের ঘরে পুত্রস্নেহে লালিত হতে লাগলেন। শৈশবে হারানো পিতা-মাতার অভাব একপ্রকার ভুলতেই বসেন তিনি। জায়েদ ছিলেন ছোট তার মনটা ও ছোট, নরম। সেখানে যে দৃশ্য রাখা হয় সেটা স্থায়ী হয় না বেশি। শিশুরা অতীত ভুলে যায় দ্রুত, একারণে মা-বাবার কথা বেশ একটা মনে পড়তো না জায়েদের।

সন্তান মা-বাবাকে ভুলে থাকতে পারে কিন্তু মা বাবা কি পারেন সন্তানকে ভুলতে? পিতা হারিসা প্রতিমুহূর্তে হারানো সন্তানের খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকেন। মা সুদা বুকের ধন কে হারিয়ে অশ্রু বিসর্জন দেন একাকী ঘরে। এভাবেই প্রায় এক যুগের অনুসন্ধান শেষ। এক সময় হারিসা জানতে পারলেন তার ছেলে জায়েদ এখন মক্কায় আছে ক্রীতদাস হিসেবে। হারিস আসলেন মক্কাপানে ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন মক্কায়। মক্কার লোকদের কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন জায়েদ নামের একটি ছেলে থাকে মোহাম্মদের বাড়িতে। হারীসা তার ভাই কাবকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তাকে নিয়ে সোজা চলে এলেন খাদিজার বাড়িতে। অনুরোধ একটাই যত টাকা লাগে লাগুক তার আপন সন্তানকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চান। পরিবারের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান জায়েদ কে? একজন ক্রীতদাস মাত্র তাকে কিনে আনা হয়েছে উকাজের বাজার থেকে বাড়ির কাজ করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে কি জায়েদ কি একজন ক্রীতদাস কেবল? জায়েদ নিজেকে কি তাই মনে করেন। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীতদাস হিসেবে দেখেন নাকি, আপন ছেলের মতোই বুকে আগলে রাখেন তাকে।

সন্তান স্নেহ দিয়ে এতদিন ধরে লালন-পালন করা জায়েদ কে হারানোর বেদনায় নবীর হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু সত্য পথের অগ্র-পথিক তিনি মানবতার মুক্তির জন্য  খুদার মনোনীত ব্যক্তি। তিনি কনিক আবেগের বসে অন্যায় করতে পারেন না। তিনি তা করেননি। যখন ছোট্ট জায়েদ নবী গৃহে এসেছিলেন তখন তিনি বালক মাত্র। এখন তিনি টগবগে তরুণ নিজের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে সক্ষম। তাই রাসুলের স্পষ্ট বক্তব্য জায়েদকে অধিকার দেওয়া হোক, সে যদি আপনাদের সঙ্গে চলে যেতে সম্মত হয়, তাহলে আমার পক্ষ থেকে মুক্ত এর জন্য মুক্তিপণের প্রয়োজন নেই। আর যদি সে যেতে অসম্মত হয় তাহলে আমি তার সম্মতির বিপক্ষে নই।এমন সহজশর্তে রাজি না হয়ে হারিসার উপায় ছিল না। এত অত্যান্ত চমৎকার বিচার ইনসাফপূর্ণ ফায়সালা। ছেলে যদি তার পিতার কাছে চলে যেতে চায় তাহলে তার পূর্ণ ইচ্ছা রয়েছে। শুধু তাই নয় তাকে মুক্ত স্বাধীন করে দেওয়া হবে দাসত্ব থেকে। তাও কোন প্রকার বিনিময় ব্যতীত, হারিছা অপেক্ষা করতে লাগলেন পুত্রের জন্য।

জায়েদ কে ভেতর হতে ডেকে আনা হলো। এত বছর পরে পিতা-পুত্রের অশ্রুসিক্ত মিলন। উপস্থিত  অন্যদের হৃদয় ও আদ্র করে তুলল জায়েদ। পিতা ও চাচা হিসেবে হারীসা ও কাবকে শনাক্ত করলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার সামনে মুক্তির দরজা খুলে দিলেন, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে স্বাধীন জীবনযাপন, যেকোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিলেন।

জায়েদের চোখ জলভরা কান্নায় চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। একদিকে অনেক আশায় বুক বেঁধে দুই হাত বাড়িয়ে তাকা পিতা হারিসা। অন্যদিকে প্রশান্ত চিত্তে অপেক্ষমাণ মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জায়েদ কোন কথা বলতে পারছেন না এ ছিল জায়েদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। পিতা-মাতা সন্তানের সুদীর্ঘ সময়ের বিচ্ছেদের পর আনন্দের মিলন। আর পিতা মাতা হীন জীবনে সদয় আশ্রয়দাতা। সবাই তাকিয়ে আছেন জায়েদের দিকে। কিছুক্ষণ পর মাথা তুললেন ক্রীতদাস জায়েদ। তিনি বললেন হে মক্কার শ্রেষ্ঠ মানব আমি আপনার পরিবর্তে অন্য কাউকে প্রধান্য দিতে পারিনা। আমার পিতা মাতা আত্বীয় স্বজনের তুলনায় আপনি আমার কাছে অধিক কাম্য। তাই আমি আপনার কাছে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভালোবাসার আলোয় আলোকিত জায়েদ, রক্তের সম্পর্কের উপরে মোহাম্মদ সাঃ এর সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দিলেন। আর বলে দিলেন এই আমার সিদ্ধান্ত।

জায়েদের বক্তব্যকে পিতা ও চাচা বুকে কষ্ট চেপে মেনে নিলেও। এবার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশান্ত হয়ে উঠলেন। ক্রীতদাস জায়েদের হাত চেপে ধরে সোজা চলে এলেন কাবা প্রাঙ্গণে। বেলা দ্বিপ্রহর কুরায়েশ নেতারা কাবার পাদদেশে উপস্থিত। কাবা সে সময় কুরাইশদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, তারা এখানে বসে বসে গল্প করছেন। এমন সময় মোহাম্মদ এর উপস্থিতি দেখা গেল, সঙ্গে তার তরুণ ক্রীতদাস জায়েদ। কুরাইশদের আলোচনা তখন তুঙ্গে। কোনরকম বনিতায় না গিয়ে সঙ্গে  থাকা তরুণটির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন এ হচ্ছে জায়েদ। আজ হতে মুক্ত এবং আমার পুত্র সে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমি তার উত্তরাধিকারী।


তখনকার আরবরা ছিল অন্যান্য সকল অঞ্চলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। অনেক অন্ধকার শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির পথের ব্যাপারে তারা ছিল একেবারেই বেখবর। এ ছিল এমন এক পৃথিবী যেখানে মানুষের সংখ্যা কম ছিল না। কিন্তু মানবতার অভাব ছিল প্রকট। সাধারণ মানুষের জীবন সম্মান, সম্পদ সবকিছু যেখানে ক্ষমতাবানের খেলার পুতুল মাত্র। সেখানে একজন ক্রীতদাসের অধিকার বলে কোন কিছু থাকার প্রশ্নই উঠে না। বাজারের ক্রীতদাস আর বনের পশুর মধ্যে তেমন পার্থক্য করা হতো না সে সমাজে। এমন সমাজে একজন  ক্রীতদাসকে শুধু মুক্ত করে দেওয়াই নয়, নিজের পুত্র বলে স্বীকৃতি প্রদান একটা প্রবল ভূকম্পন ছাড়া আর কি। সেদিন হতে মুক্ত ক্রীতদাস জায়েদ ততদিন পর্যন্ত যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ নামে সমাজে পরিচিত হলেন। যতদিন না কোরআনের বাণী রক্তের সম্পর্কিত পিতা ব্যতীত অন্য কাউকে পিতৃ পরিচয় দানের রীতি রহিত করে।

দাসত্বকে বরণ করে নেওয়া জায়েদ মুক্তি তো পেলেনই। সেইসঙ্গে মক্কার শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির পুত্র হিসেবে গৃহীত হলেন। খাদিজার ঘরেই তিনি প্রতিপালিত হতে লাগলেন। রাসুলের সাহাবীদের মাঝেও সম্মান ও মর্যাদা উচ্চসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি পরিচিত হলেন যায়েদ ইবনে হারেসা নামে ইতিহাসে।

দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর শাসনামলে তিনি জায়দ রাঃ এর পুত্র উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর রাষ্ট্রীয় ভাতা স্বীয় পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের চাইতে বেশী নির্ধারণ করেন। এতে আব্দুল্লাহ আপত্তি জানান। ওমর তাকে এই বলে চুপ করিয়ে দেন, উসামা রাসূলের কাছে তোমার চেয়ে বেশি প্রিয় ছিলেন। আর তার পিতাও আল্লাহর রাসূলের কাছে প্রিয় ছিলেন তোমার পিতার চেয়ে। একথা শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু চুপ করে যান।

খাদিজা রাঃ সঙ্গে মোহাম্মদ সাঃ এর বিয়ে হয়েছে কিছুদিন হল। সুখে-শান্তিতে কেটে যাচ্ছে তাদের দিন। খাদিজা সবসময় মোহাম্মদ কে আগলে রাখেন নিজের কাছে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোন কাজে বাইরে গেলে তিনি পেরেশান হয়ে থাকেন। ঘরের ভেতর নবীজির ফেরার পথে বসে থাকেন। তাছাড়া তিনিও চাচা আবু তালিবের মত ইহুদী বা অন্য কোন গোত্রের দ্বারা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম এর জীবন আশঙ্কার ভয় করেন। এ কারণে সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখতে চান। তিনি বাইরে থেকে ফিরে এলেই যেন তার অন্তরে স্বস্তি আসে, নয়তো সারাক্ষণ তার মন উচাটন হয়ে থাকে। এরই মধ্যে একদিন আবু তালিব তার ক্রীতদাস নাবাকে ডেকে বললেন যাও তো খাদিজার বাড়িতে, সেখানে নতুন বর -বধু কিভাবে সংসার করছে একটু দেখে আসো। মূলত আবু তালিব তার ভাতিজার ব্যাপারে সব সময় একটু বেশি খেয়াল রাখতেন। খাদিজা মোহাম্মদ কে কিভাবে বরণ করে নিয়েছেন সেটা দেখতে চাইছিলেন। নাবা নব পরিণয় সংসার থেকে ফিরে এসে আবু তালিব কে বলতে লাগলেন। আমি যা দেখেছি তা এক কথায় অসাধারণ। খাদিজা যখন মোহাম্মদকে বাড়ির দিকে আসতে দেখেন তখন তিনি দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানান। তার হাত দুটো ধরে তাকে ঘরের ভেতরে এনে বসান। এবং বলতে থাকেন আপনার জন্য আমার পিতা মাতা উৎসর্গ হোক। আপনার জন্য এই অস্থিরতা পৃথিবীতে অন্য কারোর জন্য আমার এমন অস্থিরতা হয়না। আমি জানি আপনি সেই প্রতিশ্রুতি পুরুষ কথা দিন আপনি যখন নবী হবেন তখন আমাকে ভুলে যাবেন না। আপনার অন্তর থেকে আমাকে মুছে ফেলবেন না। আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যিনি আপনাকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন।

খাদিজার এমন অস্থিরতা প্রায়ই দেখতেন। তার এমন কান্না ভেজা আরতী শুনে মোহাম্মদ সাঃ তাকে কাছে টেনে আশ্বস্ত করে বলতেন আল্লাহর কসম করে বলছি আমি যদি সত্যিই সেই প্রতিশ্রুত নবী হয়ে থাকি, তবে কোনোদিন তোমাকে ভুলে যাবো না। তোমাকে ভুলা সম্ভব নয়, কেননা তুমি আমার জন্য নিবেদন করেছো অপরিশোধযোগ্য ভালোবাসা। যার কোন প্রতিদান হয় না।

নিয়মমাফিক যেতে লাগলো পৃথিবীর দিন। শীত, বসন্ত, আবার গৃষ্ম আসতো মক্কায়। খাদিজার সংসারেও দিনকে দিন খুশির মাতোয়ারা মিছিল হতে লাগলো। বেহেশতী আনন্দে সংসারে সুখ কখনো ফিকে হতে দিতেন না। মোহাম্মদের হৃদয়ের কষ্টের বিন্দুমাত্র স্পর্শ লাগতে দিতেন না। পৃথিবীর সকল অনিষ্ট থেকে তাকে আগলে রাখতেন। খাদিজার বিয়ের দু বছর পর তার কুল জুড়ে আগমন করে এক পুত্র সন্তান। নাম রাখা হয় কাসিম, তার নাম অনুসারে মোহাম্মদ কে আবুলকাসিম ডাকা হতো। যদিও এ পুত্র হাঁটাচলার বয়সেই ইন্তেকাল করেছেন। প্রথম সন্তানের মৃত্যুতে দারুন ব্যথিত হন দুজনে। তবুও খাদিজা ভেঙ্গে পড়েননি। ব্যাথাতুর মোহাম্মদ সাঃ কে সান্তনা দিয়ে বলিষ্ঠ করেছেন। এটা বিয়ের পঞ্চম বছরের ঘটনা।

600 ঈসায়ী সাল যে বছর  কাসিম ইন্তেকাল করেন, সে বছরই খাদিজার প্রথম কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম কন্যার নাম রাখা হয় জয়নাব।

603 ঈসায়ী সালে জন্মগ্রহণ করেন দ্বিতীয় কন্যা রোকাইয়া।

605 ঈসায়ী সালে জন্মগ্রহণ করেন তৃতীয় কন্যা উম্মে কুলসুম।

608 ঈসায়ী সালে জন্মগ্রহণ করেন সততার কান্না ফাতেমা।

612 ঈসায়ী সালের নবুয়ত প্রাপ্তির তৃতীয় বছর জন্মগ্রহণ করেন খাদিজার শেষ সন্তান আব্দুল্লাহ। তিনিও দুধপান বয়সে ইন্তেকাল করেন।


চারদিকে নিকষ আঁধার এক টুকরো আলো নেই কোথাও। চারদিকে জাহিলিয়াত, মানুষের মাঝে মানবতার নাম-নিশানা অস্তিত্ব নেই। পাপের সয়লাব এসে যাচ্ছে পৃথিবীর জমিন, তামাশা ছেয় আছে সমগ্র ভূগোল। একত্ববাদী শিক্ষা বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগেই। অদ্ভুত সব ধর্ম বিশ্বাস আর দেবতায় ভরে গেছে মানুষের মন মন্দির। যে যার মত নিজস্ব ধর্ম বানিয়ে নিচ্ছে যাকে ইচ্ছা তাকে খুদা বলে স্বীকার করছে। যে জিনিস ভালো লাগছে সেটার পূজা শুরু করছে। কোথাও একত্ববাদী ধর্মের কোন আলো নেই।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর থেকে ব্যতিক্রম। আরবের মানুষের মাঝে পালিত সকল ধর্ম বিশ্বাস থেকে তিনি পবিত্র। কোন মানব নির্মিত দেবতার পূজায় তিনি কখনো হৃদয় দান করেননি। তিনি মাটির প্রতিমার সামনে কোনদিন মাথা নত করেননি। তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে পবিত্র, তিনি ধীমান ছিলেন, ছিলেন তার বংশের আদি পিতা ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া একত্ববাদী ধর্মের অনুসারী। সেসময় পৃথিবীতে এ ধর্মের নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠী ছিল না যদিও। তবু কিছু মানুষ আল্লাহকে এক নিষ্ঠা ভাবে পাওয়ার ইচ্ছায় পালন করত ইব্রাহিমীয় ইবাদত ও রীতিনীতি।

মোহাম্মদ সাঃ নির্জনে ইব্রাহিমীয় ইবাদতে ধ্যান করতেন। ইব্রাহিম আদিষ্ট একক অবিনশ্বর আল্লাহর আরাধনা করতে নিভৃতে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে। তিনি নীত হতেন আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে। তিনি জানতেন যদি তিনি ইব্রাহীমের এ ধর্ম বিশ্বাস মানুষের মাঝে থেকে পালন করেন। তাহলে লোকজন তাকে গালমন্দ করবে, তাকে পথভ্রষ্ট বলে হেয় করবে। এ কারণে তিনি নিজের ধর্ম পালনের জন্য বেছে নিলেন নির্জনতা। মক্কায় প্রায় আড়াই মাইল দূরবর্তী জাবালে নূরের পাহাড়ে একটি নির্জন গুহা হয়ে উঠলো তার ধ্যানমগ্নতার প্রদান কেন্দ্র। তাছাড়া তিনি নবুওয়াতী বয়সের যত নিকটবর্তী হতে লাগলেন, ততই আশ্চর্য সব বিষয়াবলী তার সামনে উদ্ভাসিত হতে থাকে।

একদিন তিনি রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন। তার ঘরের ছাদের কড়িকাঠ খুলে ফেলা হলো। কাঠ খুলে ফেলার কারণে ছাদের খোলা অংশ দিয়ে উপরের আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটু পর সে খোলা ছাদ দিয়ে রুপার একটি তশতরি নেমে এলো। রুপার তশতরির উপর বর করে দুজন লোক নেমে আসছে ঘরের মধ্যে। এটি ছিল একটি অভাবনীয় দৃশ্য স্বপ্ন। রূপার তশতরিতে বর করে দুজন অপরিচিত শ্বেত-শুভ্র পোশাক পরা মানুষ ভেসে আসছে। যারপরনাই ভয় পাওয়ার মত দৃশ্য, মোহাম্মদ ভয় পেলেন।তিনি সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকতে চাইলেন কিন্তু ডাকার মত কোন শব্দ জোগাল না তার মুখে। আশেপাশে কাউকে দেখতেও পেলেন না। অজ্ঞতা ভীত হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন।

রুপার তশতরিতে ভেসে আসা লোক দুজনের একজন নবীজির বুকের পাশে বসে পড়ল সে তার হাত দুটোকে দুদিকে ধরে রাখল অন্যজন বিশেষ প্রক্রিয়ায় তার বাঁ পাঁজরের দুটো হাড় আলগা করে ফেলল লোকটি তার পাঁজরের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনল তার জীবন্ত হৃৎপিণ্ড।

অস্ত্র পাচার তখনও চলছিল। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম লোকটির হাতে ধরা নিজের হৃদপিন্ডের চাপ অনুভব করতে পারছিলেন। তার কষ্ট হচ্ছিল তিনি বুঝতে পারছিলেন না লোক দুজন মানুষ নাকি ফেরেশতা। হৃৎপিণ্ড হাতে ধরা লোকটি কথা বলে উঠলো এ মহান মানুষটির হৃৎপিণ্ড অসম্ভব সুন্দর।

এরপর লোকটির সঙ্গে নিয়ে আসা একটি পাত্রে হৃৎপিণ্ডটি রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুধন করল। পরিশোধিত হৃৎপিণ্ডটি পুনরায় পাঁজরের অভ্যন্তরে প্রতিস্থাপন করে লোক দুজন ছাদের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ছাদের করিকাঠ আবার আগের মতই নিচ্ছিদ্র হয়ে রইল। মোহাম্মদ সাঃ এ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন তিনি ভীতসন্ত্রস্ত। পাশে শুয়ে থাকা খাদিজাকে ডেকে সদস্য সমাপ্ত স্বপ্নদৃশ্য বর্ণনা করলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা পেরেশান হলেন না মোটেও। তিনি ভয় পেলেন না স্বামীর বিচলিত হওয়াতে। কেন ভয় পাবেন? তিনি নিজেও তো এমন স্বপ্নের সাক্ষী। একসময় তাকেও আলোকিত করেছিল স্বপ্ন মহিমায়। তিনি তো তাঁর স্বামীর এমন আলৌকিক স্বপ্নের প্রত্যাশা করেন। তার স্বামীর এ স্বপ্ন কি তার স্বপ্নের ওই নবরুপা নয়?

খাদিজা রাঃ স্বামী মোহাম্মদ সাঃ কে নিজের দিকে টেনে নিলেন। তাকে ভালোবাসার বাহুডুরে আগলে নিয়ে অভয় দিয়ে বলেন, আপনি ভয় পাবেন না এ তো আপনার জন্য সুসংবাদ।  এ স্বপ্নের বাস্তবতা শিগগির প্রতিফলিত হবে দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ কখন আপনাকে মন্দ প্রতিদান দেবেন না। আপনি সত্যবাদী, আপনি আরবের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি, আপনি আত্মীয়তা রক্ষায় অগ্রগামী, আল্লাহ আপনাকে বিপদে ফেলবেন না। তিনি আপনাকে সুসংবাদ দেবেন সত্বর।

কখনো এমন হতো তিনি জাবালে নূরের সাধনা কেন্দ্রে যাওয়া বা আসার পথে পাশের গাছ, তরুলতা, এমনকি পাথরের ফিসফিসানি শুনতে পেতেন। সেগুলো তার নাম ধরে সম্ভাষণ জানাত। তিনি অদৃশ্যের এমন সম্ভাষণে বিচলিত হয়ে পড়তেন। জলদি এসে নিজেকে সমর্পণ করতেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার কাছে। তিনি তাকে সান্তনার পরসে আশ্বস্ত করতেন। তার যেন স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।

মক্কা থেকে জাবালে নূর দুই মাইল দূরত্বে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে হেরা গুহায় উঠতে আরো আধামাইল। খাদিজা রাঃ প্রায়ই আসেন এখানে। কখনো বা মোহাম্মদ সাঃ কে সঙ্গ দিতে, কখনো তার খবর নিতে, কখনো মুহাম্মদের খাবার শেষ হয়ে গেলে নিজেই আড়াই মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এ গুহায় আসেন। তিনি কখনো নিঃসঙ্গ অনুভব করলে এখানে রাত্রিযাপন করতেন। এবং কথা বলতেন দুজনে কখনো মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধ্যান সাধনা কিংবা নতুন কোনো অলৌকিক ঘটনার ব্যাপারে। বরাবরের মতো খাদিজা রাঃ নিজের অভিভাবকত্ব দিয়ে তুলার  মত মোহাম্মদ সাঃ এর মন থেকে উড়িয়ে দেন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ।


ভোর হলে দুজন একসঙ্গে চলে যান মক্কা নগরীতে কখনও পাহাড়ের পাদদেশে কেবল একটা বড় কাপড় টাঙ্গিয়ে রাত্রিযাপন করেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা মোহাম্মদ সাঃ এর জন্য শুকনো খাবার আর পানীয় নিয়ে আসেন সকাল হলে নবীজি খাদিজা কে বিদায় দিয়ে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার চলে যান তার সাধনা কেন্দ্রে আর খাদিজা চলে যান মক্কায়।

এত সবের পরও মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিয়ে খাদিজা রাঃ দুশ্চিন্তার অন্তর ছিল না। সর্বদা নবীজির খবর রাখার জন্য একজন ক্রীতদাস নিযুক্ত করলেন। এ ক্রীতদাস জাবালে নূরের পাদদেশে বকরি ছড়াতো এবং মাঝেমধ্যে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সার্বিক দেখাশুনা করে আসতো।

একরাতে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেয়ান মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন এক অপার্থিব সম্বোধন। হে মুহাম্মাদ! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। নবীজি শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অতিকায় এক অবয়ব বেশে আছে খালি ইতারে। তিনি জিবরাঈল(আঃ)।

 কিন্তু মোহাম্মদ সাঃ বাস্তবে কখনো কোন ফেরেশতাকে তার নিজ অবস্থায় দেখেননি। জিব্রাইল কে দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কেননা এই দৃশ্য মোটেও স্বাভাবিক কোন দৃশ্য ছিল না। অস্বাভাবিকতার ভয়ালদর্শন তাকে মুহূর্তে ভীত করে তুলল।

তিনি সাধনা কেন্দ্র থেকে দ্রুত নিচে নেমে এলেন, এবং দৌড়ে মক্কায় গিয়ে খাদিজার আশ্রয়ে নিজেকে সমর্পণ করলেন। খাদিজাকে খুলে বললেন যা তিনি এইমাত্র দেখে এসেছেন। ভয়ে তার শরীর কাপছিল, খাদিজা তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তাকে সাহস যুগালেন, থাকে নবুওতের জন্য একজন মহামানব হিসেবে প্রস্তুত করতে লাগলেন। অভয় দিয়ে বললেন আপনার কিচ্ছু হবে না। এই আপনার জন্য এক কল্যাণ সংবাদ। কারো জন্য শান্তি কামনা অবশ্যই মহৎ কিছুর ইঙ্গিতবহ।


এমন ঘটনা আরেক রাতে ঘটলো। জিব্রাইল সরাসরি তাকে সম্বোধন করে বললেন;হে মুহাম্মদ! ভয় পাবেন না, আমি জিবরাইল।

কিন্তু সাধারণ নিরক্ষর একজন মানুষ হিসেবে মোহাম্মদের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। তিনি আবার হেরা কেন্দ্র থেকে ছুটে এসে নিজেকে সমর্পন করলেন খাদিজার আঁচল তলে। আর বলছেন আমার ভয় হচ্ছে, আমি অস্থির হয়ে আছি।

খাদিজা বুঝতে পারছিলেন সময় সমাগত ঐশী কিছু একটা ঘটার জন্য সময় আসছে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে বরণ করে নেওয়ার জন্য পুরু পৃথিবী আগ্রহে অপেক্ষমান। এভাবে নবীজি যখন প্রতিবার ভয় পেয়ে আসতেন, তখন তিনি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ঘটনার বিবরণ শুনতেন। তিনি বুঝতে চেষ্টা করতেন নবুয়তের নূর ঝলক মোহাম্মদ কে চমকিত করছে কি না। তিনি তাঁকে প্রবোধ দিতেন, ভালোবাসা আর মমতার চাদরে ঢেকে নিয়ে তাকে শক্তি-সাহসে বলিয়ান করতেন। আবার স্বামীর জীবনশঙ্কার ভয় করতেন।

বস্তুত মোহাম্মদ সাঃ কে জিব্রাইলের অলৌকিক দর্শন ও শব্দের সঙ্গে পূর্ব পরিচয়। এর জন্যই এমনটি করা হয়েছিল। যাতে পরম মুহুর্তে তিনি সীমাহীন বিচলিত হয়ে না পড়েন। জিব্রাইলের কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে তাকে সাহসী করে তোলা হচ্ছিল। আর ঘরে খাদিজা ছিলেন তাঁর মানসিক ভরসার অন্যতম শক্তি কেন্দ্র, সকল শঙ্কা, ভয়, দুশ্চিন্তা থেকে তিনি তাকে মুক্ত করে আনতেন। মানবীয় ভালোবাসায় কখনো তাকে ভীত হতে দিতেন না।

এরপর থেকে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগলো। কখনো তিনি অপার্থিব আলো দেখতে পান। কখনো অদৃশ্যের সম্বোধন শুনতে পান। কখনো প্রকৃতির অস্বাভাবিক কোন দৃশ্য দেখতে পান। খাদিজাকে তিনি প্রতিটি ঘটনা বর্ণনা করতেন। এসব শুনে তিনি তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা ঘটনাগুলো শুনেই বুঝতে পারলেন, মোহাম্মদের সময় আত্যাসন্ন। তিনি মোহাম্মদ কে অভয় দিয়ে বললেন; আপনার বর্ণিত এসব ঘটনা যদি সত্য হয়। তাহলে তিনি তো সে ফেরেশতা, যিনি মূসা নবীর কাছে পয়গাম নিয়ে আসতেন। ভয়ের কিছু নেই, আমার জীবদ্দশায় যদি আপনি নবুওয়াত প্রাপ্ত হন তাহলে আমি আপনাকে পূর্ণ সমর্থন জানাবো। আপনার নবুওতি কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করবো। এবং আপনার উপর প্রেরিত ধর্মের প্রতি ঈমান এনে সম্মানিত হব।  হায়! যদি আমি ততদিন বেঁচে থাকতাম।

মোঃ মূলত খাদিজা ও ওয়ারাকা এবং পূর্বেকার অনেক আলৌকিক ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে যদিও এমন কিছু আশা করছিলেন। হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু তিন আসলে জানতেন না নবুয়্যাতের সত্যিকারের প্রত্যাদেশ কেমন হয়। বা কিভাবে আল্লাহর প্রত্যাদেশ ধরার বুকে আগমন করে। কারণ তিনি নিরক্ষর ছিলেন, পড়তে জানতেন না। পূর্বেকার কিতাবের বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল সামান্য। তিনি আরবের আর সবার থেকে আলাদা ছিলেন। সবার চেয়ে উন্নত মানসিকতা এবং চারিত্রিক নিষ্কলুষতায় তাকে নিয়ে বাজি ধরা যেত।

10 আগস্ট 610 ঈসায়ী মোতাবেক রমজানের 21 তারিখ, রমজান মাসে মুহাম্মদ সাঃ সাধারণত অন্যান্য মাসের তুলনায় একটু বেশি ধ্যানমগ্ন হন। কখনো তিনি পুরো মাস জাবালে নূরের হেরা গুহায় কাটিয়ে দিতেন। এবারও তিন পুরু মাস হেরাকেন্দ্রে নির্জন বাসের জন্য মাসের শুরুতে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। মাঝে খাদিজা রাঃ এসে কয়েকবার সাক্ষাৎ করে গেছেন। খাবারের প্রয়োজনে ক্রীতদাস এসে খাবার দিয়ে যায়। তিনি পূর্ণ রমজান মাস এখানে অবস্থানের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।

রাত্রিবেলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ কোনো আলোর ঝলকানিতে তিনি জেগে উঠলেন, জেগে দেখলেন আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা জিব্রাইল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে এক খন্ড রেশমের টুকরো। তাতে আরবিতে কিছু লেখা আছে জিবরাঈল বললেন পড়ুন।

সদ্য ঘুম থেকে জেগে মুহাম্মদ সাঃ হতবিহ্বল অবস্থায় ছিলেন। চোখের সামনে চমকিত জিব্রাইলকে দেখে তিনি কি করবেন বুঝতে পারছিলেন। না ভয় পাওয়া তার হৃদয় থেকে আপনি বেরিয়ে এলো আমি পড়তে জানি না। জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগিয়ে এসে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন। নবীজির মনে হতে লাগল তার বুকের হাড় গুলো না ভেঙ্গে যায়। তাকে ছেড়ে দিয়ে জিব্রাইল আবার বললেন "পড়ুন" মোহাম্মদ সাঃ আগের মতোই বললেন আমি তো পড়তে জানি না। জিবরাঈল আবার তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার পড়তে বললেন। তিনি একই উত্তর দিলেন এবার জিব্রাইল তাকে আরো দীর্ঘক্ষন বুকের সঙ্গে ধরে রাখলেন। মোহাম্মদ সাঃ এর নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। একসময় জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই আবৃত্তি করলেনঃ

পড়া তোমার প্রভুর নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ো এবং তোমার প্রভুর নামে যিনি অত্যান্ত দয়াবান, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।

এবার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়তে পারলেন। তিনি জিবরাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লামের উচ্চারিত বাণীগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। মনে হচ্ছিল এ বাণীগুলোর প্রতিটি শব্দ, অক্ষর তার অন্তঃকরণে খোদাই করে দেওয়া হয়েছে। তিনি তা বারবার পড়তে লাগলেন।







1 টি মন্তব্য: