বিষাদ আনন্দে রূপ নিয়েছে

 

❤গল্পঃ বিষাদ আনন্দে রূপ নিয়েছে ❤
লেখকঃ হাসান মাহমুদ
রাতুলের পড়ালেখা ভালো লাগেনা। তাই সে স্কুলে যেতে চায়না। তাকে নিয়ে তাঁর বাবা-মা অনেক চিন্তিত। তাঁরা তাকে সবধরণে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। তাকে বুঝাতে বুঝাতে সবাই ক্লান্ত।
একদিন রাতুলের বাবা তাকে বললেনঃ রাতুল! তোকে আর স্কুলে যেতে হবেনা। আয় বাবার সাথে কাজে যাবে। এখন থেকে বাবা ছেলে মিলে কাজ করবো। আর কষ্ট করে স্কুলে যেতে হবেনা তোকে।
রাতুল বাবার কথা শুনে তো মহা আনন্দে মেতে উঠে। যেন আজ তাঁর ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে। সে জোয়াল কাঁধে নিয়ে ছোটে চললো মাঠের দিকে। দীর্ঘক্ষণ হাটারপর রাতুল বললোঃ বাবা! আমাদের জমি আর কতদূর? বাবা বললেনঃ এইতো সামনে আরেকটু। এভাবে তাঁরা আরো দু’ঘণ্টা হেটে অন্য এক গ্রামের মাঠে চলে গেলেন। রাতুল জোয়াল কাঁধে নিয়ে হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। যেন শরীর আর এগুতে চাচ্ছেনা। কিন্তু আর স্কুলে যাওয়া লাগবেনা, তাই সে এসব সহ্য করে যাচ্ছে।
এবার রাতুলের বাবা জোয়াল তাঁর গাঁড়ে তোলে দিলেন, আর বললেনঃ এবার তুমি এটাকে টানতে থাকো। রাতুল বললোঃ বাবা আমি কেন এটাকে টানবো? এটিতো গরু টানার কথা। বাবা বললেনঃ তুমি কি জানোনা আমাদের গরু নেই। ভাড়ায় গরু আনার টাকা আমার কাছে নেই। তুমি আসায় আমার অনেক ভালো হয়েছে। আগে আমি একা জোয়াল টেনে হাল চাষ করতাম, এখন থেকে বাবা ছেলে মিলে টানবো। রাতুল কিছু না বলে জোয়াল টানতে লাগলো, আর তাঁর বাবা লাঙ্গল ধরে হাল চাষ করতে লাগলেন।
এভাবে সাকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে, কাঁধ থেকে জোয়াল নামানোর কোন কথাই বলছেননা তাঁর বাবা। একটা সময় আর শরীর মানলোনা। সে কাদার মধ্যে লুটিয়ে পড়লো। বাবা বললেনঃ কী হয়েছে রাতুল? তুমি এভাবে পড়ে গেলে যে। রাতুল বললোঃ বাবা আমি আর পারছিনা। বাবা বললেনঃ এভাবে তো হবেনা। আচ্ছা তুমি একটু খাবার খেয়ে বিশ্রাম নাও। আমরা খাবার খাওয়া শেষে আবার কাজ শুরু করবো।
রাতুলের খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। সে পানির বোতলটি ঝাপটি মেরে ধরে পানি খেতে লাগলো। এবার সে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবারের থলি খোলতে লাগলো। দেখে থলিতে শুধুমাত্র ভাত, লাল মরিচ আর লবণ রাখা। রাতুল বললোঃ বাবা! আমি এগুলো কীভাবে খাবো? বাবা বললেনঃ কেন তুমি এগুলো খাবেনা? আমিতো এগুলো প্রতিদিন খাই। এতদিন তুমি স্কুলে যাবে বলে তোমার মা আর আমি অনেক কষ্ট করে কিছু ভালো তরকারি জোগাড় করতাম, তুমি সেগুলো খেয়ে স্কুলে যেতে। এখনতো আর তুমি স্কুলে যাবেনা। তুমি বাবার মত কৃষক হতে চাচ্ছো, তাই তোমাকে আর ওই খাবারের আশা করলে হবেনা। এখন থেকে একজন কৃষক যা খায়, তুমিও তা খাবে।
রাতুল কিছু না বলে চোখের কোণে পানি নিয়ে বাবার সাথে মরিচ দিয়ে খাবার খেতে লাগলো। খাবার খাওয়া শেষ হতে না হতেই আবার কাজ শুরু করে দিতে হলো। এভাবে কাজ সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো। কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলো, তখন তাঁর পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত। হাত-পা ফুলে গেছে। ভেবেছিলো বাড়ি ফিরে মায়ের আদর পেলে সব কষ্ট মুছে যাবে। যেমনটি মায়ের আদরে স্কুলে থাকার কষ্টগুলো বাড়ি ফিরলে মুছে যেতো।
কিন্তু আজ তেমন কিছুই হলোনা। বাড়ি আসার সাথে সাথে মা রাতুলের হাতে একটা গামছা দিয়ে বললেনঃ যাও! গোসল করে এসো। রাতুল হতাশ হয়ে গোসল করে এসে দেখে, মা তাঁর জন্য মরিচ আর পিয়াজ দিয়ে খাবার সাজিয়ে রেখেছেন। সে কিছু না বলে খেতে লাগলো। এভাবে রাতুলের দিনগুলো যেতে লাগলো। যেন মনে হলো পুরো পৃথিবীতে পাল্টে গেছে। যে পৃথিবীতে মায়া-দয়া বলতে কিছুই নেই। আছে শুধু দরিদ্রতা, হতাশা, দুঃখ-কষ্ট।
এক সাপ্তাহপর রাতুল আর হাটতে পারছেনা। পুরো শরীর ফুলে গেছে। ক্ষত জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কাপুনি দিয়ে জর এসেছে। টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারছেনা। ব্যাথার যন্ত্রণায় শুধু কাতরাচ্ছে। গভীর রাতে হঠাৎ সে চিতকার দিয়ে কেদে উঠে। বাবা-মা দৌড়ে রাতুলে কাছে আসলে, সে বলেঃ মা! আমি স্কুলে যাবো। আমি পড়ালেখা করবো। আমি তোমাদের দুঃখ মুছে দিবো। আমি দেখেছি তোমাদের জীবন। এই জীবন থেকে তোমাদের মুক্তি দিবো।
পরদিন থেকে রাতুল স্কুলে যেতে শুরু করে। শুরু করে নতুন উদ্যমে পড়ালেখা। সে প্রতি পরীক্ষায় প্রথম হতে লাগলো। তাঁর এমন পরিবর্তনে শিক্ষক, সহপাঠিরা সবাই অবাকে হয়ে গেলো।
আজ সে ডাক্তার হয়েছে। প্রথম রুজি দিয়ে বাবা-মায়ের জন্য কাপড় আর ভালো খাবার নিয়ে বাড়ি গেছে। বাবা-মা তাঁর গাঁয়ে ডাক্তারের পোশাক দেখে কান্না চোখে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। এ’কান্না দুঃখের কান্না নয়। এ’কান্না ক্ষুধার কান্না নয়। এ’কান্না কোন ব্যাথার কান্না নয়। এ’কান্না আনন্দের। আজ রাতুল পেরেছে তাঁর বাবা-মায়ের বিষাদের কান্নাকে আনন্দে রূপ দিতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন